এক সপ্তাহে ৫ খুন, ২১ ছুরিকাহত— পুলিশ বলছে পরিস্থিতি ‘ভালো’
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৭
যশোর: যশোরে দিনদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। নতুন বছরের শুরু থেকেই হত্যা, ছুরিকাঘাতের ব্যাপকতা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পাঁচটি। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারির প্রথম ১২ দিনে ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো অন্যান্য অপরাধ তো রয়েছেই। এ অবস্থাতেও পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি ভালো আছে।
পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণে দেখা যায়, যশোরে চলতি মাসের ১২ দিনে পাঁচজন খুন হয়েছেন, ছুরিকাহত হয়েছেন ২১ জন। এর বাইরে কয়েকজনকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করা হয়েছে। একই সময়ে দুটি ইজিবাইক ছিনতাই হয়েছে। এ ছাড়া চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারির দৌরাত্ম্যও বেড়েছে।
সম্প্রতি আলোচনায় ঠাঁই পেয়েছে মামা-ভাগনের আত্মহত্যা, চৌগাছায় মেয়েকে বিষপান করিয়ে হত্যাচেষ্টা ও মায়ের আত্মহত্যার চেষ্টা, মণিরামপুরে শালিসের নামে প্রবাসীর স্ত্রীকে নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির মতো ঘটনাগুলো। দেয়াল কেটে সোনার দোকানে চুরির ঘটনাটি আলোচিত হলেও শহরে চুরির ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে জানুয়ারি মাসে ছয়টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, চুরির ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, তারা একের পর এক চুরির ঘটনায় অতীষ্ঠ হয়ে গেলেও থানায় গেলে চুরির অভিযোগ নিতে চায় না পুলিশ।
সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ খুন
যশোরে সর্বশেষ খুনের ঘটনা ঘটেছে অভয়নগরে, গত রোববার রাতে। নিহত হয়েছেন ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা মুরাদ হোসেন (২৮)। এ ঘটনা ঘিরে রোববার মধ্যরাতে নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ আব্দুস সালামের অস্থায়ী কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করতে হয়।
রোববারই সকাল ১০টার দিকে রাজারহাট রামনগরের সুতিঘাটা এলাকায় গণপিটুনিতে প্রাণ হারান সদর উপজেলার গোলদার পাড়া সুতিঘাটা গ্রামের জালাল উদ্দিন গাজীর ছেলে ফয়েজুল গাজী (২৭)। চোর সন্দেহে তাকে রাতভর নির্যাতনের করে হত্যার অভিযোগ ওঠে।
এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় খুন হন জুম্মান সরদার (৩৮)। শংকরপুর রেলগেট মোড়ের পকেটমার মুরাদ হোসেনের ছেলে জুম্মান এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। তার নামে কোতোয়ালি থানায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পূর্বশত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে জুম্মান খুন হন বলে জানা গেছে।
এর আগের দিন শুক্রবার সুদের টাকা আদায় নিয়ে বিবাদের জের ধরে প্রাণ দিতে হয় নুরপুর গ্রামের মছি মন্ডলের ছেলে নিহত মহাসিনকে (৪২)। চড়া সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় মেহেদী হাসান লিখনকে গালিগালাজ করেছিলেন তিনি। এর জের ধরে ল্যাপটপের চার্জারের তার দিয়ে মহাসিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন লিখন। পরে তাকে ট্রাংকে ভরে ডিজেল ঢেলে সেই ট্রাংক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। যশোর শহরতলীর বালিয়াডাঙ্গা মানদিয়া জামে মসজিদের পেছনে পাওয়া যায় মহাসিনের অগ্নিদগ্ধ বিকৃত মরদেহ। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় উপশহরে স্বামী পরিতোষ কুমার পিটিয়ে হত্যা করেন তার স্ত্রী রমা রানীকে।
ছুরিকাঘাতের ঘটনা বাড়ছে, রয়েছে অন্যান্য অপরাধ
৩ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ছুরিকাঘাতে আহত হন ৯ জন। ৬ ফেব্রুয়ারি ছুরিকাহত হন আরও ৯ জন। এ সময়ে দুটি ইজিবাইক ছিনতাই হয়।
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, প্রায় প্রতিদিনই তারা ছুরিকাহত রোগী পাচ্ছেন। এর মধ্যে ৪ ফেব্রুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় ৯ জন করে ছুরিকাহত ব্যক্তিকে নেওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। তাদের বেশ কয়েকজনই ছিল কিশোর।
এদিকে ১১ ফেব্রুয়ারি চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের হাতে জখম হন শেখ মোহাম্মদ রিপন ও অহিদুল ইসলাম। ৮ ফেব্রুয়ারি ছুরিসহ পুলিশের হাতে আটক হয় দুই কিশোর। ২ ফেব্রুয়ারিতে খড়কির তরিকুল ইসলাম আহত হন।
এ মাসের প্রথম এই ১২ দিনে পুলিশ বেশ কয়েকজন মাদক কারবারিকে আটক করেছে। গ্রেফতার করেছে হত্যা মামলার বেশ কয়েকজন আসামিকেও।
গ্যাং আর বাহিনী নিয়ে অভিযোগ বিস্তর
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, খুন ও ছুরিকাঘাতের মতো অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা বাহিনী গড়ে উঠেছে। এলাকার ‘বিশেষ বড় ভাই’দের ছত্রছায়ায় তাদের প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, ওই প্রভাবের জেরে বিচার-শালিস, জমিজমার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত তারাই দিতে শুরু করেছে। এসব কাজের জন্য চাঁদা নেওয়া হলেও ওই সব বাহিনী একে চাঁদা বলতে নারাজ। তারা বলে থাকে ‘ফি’। এর বাইরে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ ও এলাকার আধিপত্যও তারা নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা করে থাকে।
ভুক্তভোগীসহ সাধারণ মানুষ বলছেন, আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে কখনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লেই এসব বাহিনী নৃশংস হয়ে ওঠে। আঘাত করতে পিছুপা হয় না। কখনো এক বাহিনীর সঙ্গে অন্য বাহিনীর দ্বন্দ্বেও রক্ত ঝরে। এসব অপরাধের পর তাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনীহা ও গাফিলতির অভিযোগও করছেন স্থানীয়রা। তাদের ভাষ্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই নিষ্ক্রিয় নীতির কারণেই বাহিনীগুলো অপরাধের রাজত্ব কায়েম করেছে।
এসব নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা কেউ মন্তব্য করতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোতোয়ালি থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কিশোর গ্যাং বা গজিয়ে ওঠা বাহিনীগুলোর পেছনে অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় রয়েছে। সে কারণে সবসময় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
পরিস্থিতি ভালো বলছে পুলিশ
এত কিছুর পরও যশোরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ভালো রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জেলা পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার। গত রোববার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় এসপি বলেন, কিছু সমস্যা হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো রয়েছে।
প্রলয় কুমার জোয়ারদার বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ বিভাগকে অনেক কাজ করতে হয়েছে। বাড়তি দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে। এ কারণে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দৃষ্টি হয়তো কিছুটা কম দিতে হয়েছে। এখন থেকে শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
সারাবাংলা/টিআর