ছন্দ হারিয়েছে বইমেলা— আক্ষেপ বইপ্রেমীদের
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:৪৭
ঢাকা: বইমেলা যেন আর বইয়ের মেলা নেই— বইমেলার শুরু থেকেই এই অভিযোগ নানা মহলে। কিন্তু কেন? কারও কাছে ভালো লাগে না অযাচিত ভিড়, কারও কাছে বিড়ম্বনা অতিরিক্ত স্টল ও প্যাভিলিয়নের ভিড়ে গোলকধাঁধায় পড়ে যাওয়া, কারও কাছে বিরক্তিকর বইমেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা কাবাব-বিরিয়ানির দোকান। সবমিলিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হলেও বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে— এমন আক্ষেপ অনেকেরই।
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার তৃতীয় শুক্রবার বই বিক্রি বাড়লেও মেলায় কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ না পেয়ে আক্ষেপ করতে দেখা গেছে বইপ্রেমী ও বিক্রেতা উভয়কেই। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় তুলনামূলক ভিড় থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু বইমেলার এত বড় পরিসরেও যেন ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী’ দশা। মেলায় আসা দর্শনার্থীদের অনেকেই ঘুরে ঘুরে বই দেখা ও কেনায় ব্যস্ত ছিলেন। তবে এর বাইরে বড় একটি অংশকেই পার্কে ঘুরতে যাওয়ার মতো সময় কাটাতে দেখা গেছে। বই দেখা, বই কেনা, বই সংক্রান্ত আলোচনা শোনা ও অংশ নেওয়ার চেয়েও মেলায় আসা বড় একদলের বেশি আগ্রহ দেখা গেল ছবি তোলা, বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরি আর খাওয়া-দাওয়ায় ‘ব্যস্ত’ সময় কাটাতে।
মেলার পূর্ব দিকে খাবারের দোকানের সামনে খোলা মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন তরুণ। তাদের কেউ তরুণ লেখক, কেউ পাঠক। কথায় কথায় জানালেন, বইয়ের টানে ঠিকই মেলায় আসেন তারা। কিন্তু মেলার পরিবেশ তাদের ভালো লাগে না।
ওই তরুণরা বললেন, লোকজন বই কিনছে না, কিন্তু খাবারের দোকানে উপচে পড়া ভিড়। এখানে অতিরিক্ত দাম দিয়ে কাবাব-বিরিয়ানি খেলেও বই কিনতে গেলে দামের অভিযোগ করেন। কাগজ-কালিসহ আনুষঙ্গিক জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দাম বেড়েছে, অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বইমেলায় তো বই কিনতেই আসা উচিত। কাবাব-বিরিয়ানি খাওয়ার টাকা থাকলে বই কিনতে সমস্যা কোথায়— প্রশ্ন তাদের।
এদিকে বইমেলার খাবারের দোকানগুলোতে অতিরিক্ত দামের অভিযোগও করেন কেউ কেউ। সঙ্গে আসা দুই শিশুর জন্য ১৬০ টাকা দিয়ে দুটি চকবার আইসক্রিম কিনে ক্ষোভ জানালেন এক অভিভাবক। বলেন, ‘২৫ টাকার ইগলু চকবার ৮০ টাকায় বিক্রি করছে। বাচ্চাদের জন্য বাধ্য হয়ে কিনলাম।’
বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় এসে ভিড়ের মধ্যে দোকান খুঁজে পেতে অসুবিধার কথা জানালেন কয়েকজন। বললেন, আমরা চাকরি করি বলে শুক্রবার বা শনিবার ছাড়া আসতে পারি না। এখন এসেই তো বিপদ। সেলফিশিকারী আর ঘুরতে আসা মানুষের ভিড়ে আমরা পাঠক ও বইয়ের ক্রেতারা বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা শান্তিমতো ঘুরে ঘুরে বই দেখতে পারছি না। এখানে উদ্যানে ঘুরতে আসা মানুষের ভিড়ই যেন বেশি।
তাদের বন্ধুদের একজন মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই বইমেলা আমাদের অত্যন্ত আবেগের জায়গা। আমরা দলবেঁধে এসেছি। আড্ডা দিয়েছি। বইমেলায় লেখকরা আসেন। তাদের দেখা পাওয়া, তাদের সঙ্গে কথা বলা ছিল পরম পাওয়া। সেই লোভে আসতাম। প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে উঠতাম। কিন্তু এখন যেন এটি হয়ে গেছে ঢাকার আর দশটা পর্যটন কেন্দ্রের মতো। ছুটির দিকে কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে মানুষ বইমেলায় চলে আসে। তাদের বই নিয়ে না আছে আগ্রহ, না আছে বইয়ের প্রতি প্রেম। আমাদের অনেক বন্ধুই এখন আর এসব কারণে বইমেলায় আসতে চান না।’
বইমেলা নিয়ে বইপ্রেমীদের এমন সব বিরক্তির কারণগুলো পরিস্ফূট হলো মেলা পরিদর্শন করতেই। মেলায় যারা আসছেন তাদের বড় একটি অংশই মত্ত প্রদর্শনবাদিতায়, যার নিদর্শন পদে পদে। বইয়ের যে স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলো নির্মাণশৈলীর দিক থেকে দৃষ্টিনন্দন, সেগুলোতে যেন সারি ধরে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন সবাই।
মেলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় মিডিয়া সেন্টারে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের স্টল ও সাময়িক লাইভ স্টুডিও। দড়ি দিয়ে ঘেরা অংশ টপকেও অনেকে সেখানে সেলফি বা ছবি তুলছেন। বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন অংশেও সেলফি ও ছবিশিকারীদের ভিড়। বাদ নেই টেলিভিশন ক্যামেরার জন্য স্থাপিত উঁচু পাটাতনগুলোও। অল্পবয়সী কিশোররা সেখানেও ভিড় করে দাঁড়িয়ে। কেন তারা সেখানে উঠেছে, তা নিজেরাও জানে না।
সেলফিশিকারীদের ভিড়ে বিরক্ত বিক্রেতা ও প্রকাশকরাও। একাধিক প্রকাশক ও বিক্রেতা বললেন, লোকজন স্টলে এসে বই নিয়ে ছবি তুলে চলে যায়। বলতে গেলে তাদের কেউই বই কেনেন না।
একজন প্রকাশক বললেন, ‘দুয়েকটা ছবি তুলে চলে গেলেও হয়। কিন্তু তা না। বইয়ের পাতা উলটে-পালটে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলতে তুলতে বই-ই নষ্ট করে দেয়। ভাবছি ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা দেবো।’
সংবাদে নাম প্রকাশ করতে অবশ্য রাজি হননি এই প্রকাশক। তবে তার বক্তব্যের মতো বই নষ্টের প্রমাণ পাওয়া গেল বেশ কয়েকটি স্টলেই। জনপ্রিয় লেখক অনীশ দাশ অপুর ‘ভূতের গল্প সমগ্র’ বইটি হাতে নিয়ে দেখা গেল একদম নড়বড়ে অবস্থা। জানা গেল, এটিই এই সংস্করণের শেষ বই। বই হাতে নিয়ে ছবি তুলিয়েদের জন্য বইয়ের এই দশা।
এদিকে বইমেলায় খাবারের দোকান, বিশেষ করে কাবাব ও বিরিয়ানির মতো ভারী খাবারের বিক্রি নিয়েও আপত্তি রয়েছে অনেকের। তারা বলছেন, বইমেলায় তো মানুষ সারাদিনের জন্য আসে না। যেটুকু সময়ের জন্য মেলা আসে, ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধা বা পিপাসা পেলে চা-পানি বা হালকা স্ন্যাকস খাওয়ার ইচ্ছা জাগতেই পারে। সেখানে কাবাব-বিরিয়ানির মতো ভারী খাবারের ব্যবস্থা বইমেলার সঙ্গে একেবারেই বেমানান বলে অভিমত তাদের।
মেলার আয়োজক তথা বাংলা একাডেমি অবশ্য ক্রেতা-দর্শনার্থী ছাড়াও বইমেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশনীগুলোতে কর্মরত প্রায় দেড় হাজারের বিক্রয় প্রতিনিধির দুপুর ও বিকেলের খাবারের কথা বিবেচনায় নিয়ে ভারী খাবারগুলোর স্টলগুলো বসানোর অনুমতির কথা জানাচ্ছে। তবে প্রকাশকরা বলছেন, এসব স্টলে অতিরিক্ত দামের কারণে কর্মীদের জন্য তারা এখান থেকে খাবার কেনেন না। তারা খাবার নিয়ে আসেন বাইরে থেকে। একাধিক প্রকাশক সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাইরে থেকে যে খাবার ১০০ টাকায় আনতে পারছি, সেই খাবার মেলা থেকে ৩০০ টাকায় কেনার কোনো মানে হয় না।’
বইপ্রেমীরা বলছেন, বই মানুষের সৃজনশীলতা প্রকাশের একটি মাধ্যম। তাই বইকেন্দ্রিক সমাবেশ বা মেলার মধ্যে তুলনামূলক রুচি ও ভাবগাম্ভীর্য থাকা প্রয়োজন। থাকা প্রয়োজন শৃঙ্খলাও। কিন্তু বইমেলায় সেই শৃঙ্খলার দেখা মেলা ভার। শিশুচত্বরে সিসিমপুরের মঞ্চে যেমন অভিভাবকদের ভিড়ে শিশুদেরই যাওয়ার উপায় নেই! বইমেলা ঘুরে দেখা গেল না ডাস্টবিনও।
এসব বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলা একাডেমির বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলার সার্বিক ব্যাবস্থাপনা ঠিক রাখতে আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছি। পানি ছিটাচ্ছি নিয়মিত, যেন ধূলা না হয়। কিন্তু মানুষের আচরণ তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। লোকজন যদি আসে আর বই না কিনে সেলফি তোলে, সেটি আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব? তবে আগামী বইমেলা থেকে মানসম্মত বই প্রকাশ করে না— এমন প্রকাশকদের আমরা স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার চিন্তা করছি।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শনীর স্থাপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো একদিনের মধ্যে করা হয়েছে। আশা করছি দুয়েকদিনের মধ্যেই এটি ঠিক করা হবে। এখানে সংলাপের জন্য উপযুক্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বইমেলা চত্বরে পর্যাপ্ত ডাস্টবিন না থাকা বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো দিয়েছিলামই। কিন্তু ফিল্ডে গিয়ে দেখি নেই। অনেকেই দোকানের ভেতরে রাখেন। এ বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হবে।’
বইমেলায় খাবারের দোকান নিয়েও প্রশ্ন রাখা হয় মেলা পরিচালনা কমিটির এই সদস্যসচিবকে। জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি বাংলা একাডেমির একক সিদ্ধান্ত নয়। বইমেলায় কর্মরত ব্যক্তি ও দর্শনার্থীদের কথা চিন্তা করেই এখানে খাবারের দোকানের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। গতবার মেলার সঙ্গেই জায়গা দেওয়া হলেও এবার আমরা মেলা থেকে বেশ দূরেই রেখেছি। তাও অনেক দোকান নয়, ১২ থেকে ১৪টি দোকানই জায়গা পেয়েছে।’
বইমেলায় ভারী খাবারের প্রয়োজন নেই স্বীকার করে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এটি নিয়ে ভেবে দেখা হবে। আসলে ২০১৩ সালের আগে বাংলা একাডেমি চত্বরে যখন বইমেলা ছিল, তখন শুধু বাংলা একাডেমির ক্যান্টিনই ছিল ভরসা। পরে সোহরাওয়ার্দী প্রান্তে মেলা সম্প্রসারিত হলে আমরা সবার পরামর্শেই খাবারের দোকানের অনুমতি দেই। এদিকে স্ট্রিটফুড ছাড়া আশপাশে খাবারের দোকান তেমন নেই। সেগুলো খেয়ে কেউ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, সেটিও আমরা বিবেচনায় রেখেছিলাম। এখন মানুষ ঢাকায় এত খাবারের দোকান রেখে বইমেলায় নিশ্চয়ই খেতে আসে না! তারপরও ভারী খাবারের জন্য যদি বইমেলার পরিবেশে কোনো সমস্যা হয়, সেটি বিবেচনা করা হবে।’
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর