নিরিবিলি পরিবেশে পরিবার নিয়ে বইমেলায় পাঠক-দর্শনার্থী
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:৪১
বিকেল সাড়ে ৩টা। রমনা কালী মন্দির গেট দিয়ে অমর একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ঢোকার সময় চোখ আটকে গেল চমৎকার এক দৃশ্যে। আট-দশজন নারী একজন আরেকজনের মাথায় ফুলের টায়রা পরিয়ে দিচ্ছেন। এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠজনের বয়স এক থেকে দেড় বছর, সর্বজ্যেষ্ঠজন সত্তরের কাছাকাছি! বাকিদের কেউ তরুণী, কেউ কিশোরী, কেউ ষোড়শী, কেউ বা মধ্যবয়সী বাঙালি কুলবধূ।
একটু দূরে সফেদ পা’জামা-পাঞ্জাবি পরা সত্তরোর্ধ্ব শ্মশ্রুমণ্ডিত যে মানুষটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নান্দনিক এই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন, তিনি যে এই নারীকূলের অভিভাবক, তা বুঝতে বাকি রইল না। গোলাপ-গাঁদা-জিপসি ফুলের টায়রা পরা রমণীরা যখন মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে ব্যস্ত, তিনি তখন নরম সুরে বলছিলেন, “ছবি তোলা শেষ করো। ভিড় বেড়ে যাওয়ার আগেই মেলায় ঢুকতে হবে। নইলে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ‘ঝামেলা’য় পড়তে হবে।”
হ্যাঁ, ঝামেলা এড়াতে শুক্র-শনিবার বাদ দিয়ে বইমেলার ১৯তম দিন সোমবার কর্মদিবসে অনেকেই সপরিবারে মেলায় এসেছিলেন। ঢাকার ওয়ারী থেকে বইমেলায় আসা আমজাদ হোসেন তাদের মধ্যে ভিন্ন মানসিকতার বৈকি! দেড় বছরের নাতনী থেকে শুরু করে সত্তরের ঘরে পা রাখা প্রিয়তমা স্ত্রী রুকাইয়া বেগমকেও বইমেলা ভ্রমণ থেকে বাদ দেননি তিনি। ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে, মেয়ের ছেলে-মেয়ে— কেউ বাদ যায়নি।
রমনা কালী মন্দির গেটে কথা হয় আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বইমেলা আমাদের কাছে বিরাট এক উৎসব। প্রতি বছরই চেষ্টা করি পরিবার-পরিজন নিয়ে একবার হলেও বইমেলায় আসার। যেহেতু শুক্র-শনিবার প্রচণ্ড ভিড় থাকে, সেহেতু রবি থেকে বৃহস্পতি বারের মধ্যে যেকোনো একটি দিন বেছে নিই।’
আরও পড়ুন- নীতিমালা লঙ্ঘন: সতর্কবার্তা পেল আরও ৭ প্রতিষ্ঠান
সবাইকে নিয়ে বইমেলায় আসার কারণ সম্পর্কে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘মেয়েরা তো ঘরেই থাকে। খুব একটা বের হওয়ার সুযোগ পায় না। তাই সবাইকে নিয়ে বইমেলায় আসা। আর বাসার নারী সদস্যরা এলে তো বাচ্চারা আসবেই।’
ঈদ, পূজা, বড়দিন, পহেলা বৈশাখের পর রাজধানী ঢাকায় অমর একুশে বইমেলা যে সবচেয়ে বড় উৎসব, তাতে সন্দেহ নেই। এই উৎসবে সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। অন্য উৎসবগুলোর ক্ষেত্রে সম্প্রদায় বা ধর্মীয় বিভাজনের রেখা থাকলেও বইমেলা সেটি থেকে মুক্ত। সব ধর্মের, সব বিশ্বাসের লোক একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে অমর একুশে বইমেলা বিশাল এক প্ল্যাটফর্ম।
বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির গাফিলতি ও দায়সারা গোছের কাজ নিয়ে হাজার প্রশ্ন করার সুযোগ সবসময় থাকে। তবে বইমেলার ১৯তম দিনে এসে হলেও ধুলামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হওয়ায় অনেকেই স্বস্তির কথা জানিয়েছেন। অবশ্য বইমেলার প্রথম দুই ঘণ্টার পরিবেশ শেষ তিন ঘণ্টার সঙ্গে নাও মিলতে পারে!
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে কথা হয় রাকিব উন নীবর সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ধুলামুক্ত ও ভিড়হীন বইমেলার কথা চিন্তা করে পরিবার নিয়ে আজ এসেছি। মিডিয়াতে যেভাবে ধুলার কথা শুনেছি, পড়েছি, দেখেছি, আজ সেরকম মনে হচ্ছে না। প্রচুর পানি ছিটিয়েছে বোধ হয়। দিন শেষে ধুলা বাড়তে পারে।’
সাধারণত কর্মদিবসগুলোতে বইমেলায় দর্শনার্থী ও পাঠক তুলনামূলক কম থাকে। তবে এই কমসংখ্যক মানুষের মধ্যে ক্রেতার সংখ্যা থাকে বেশি। প্রকৃত পাঠক ভিড়হীন দিন বেছে নেন— এমনটিই চলে আসছে বহুকাল ধরে। সোমবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
এদিন বইমেলায় তুলনামূলক ভিড় কম হলেও বিক্রি ছিল ভালো। মানসম্মত বইয়ের প্রকাশনীগুলোর স্টল-প্যাভিলিয়নে দর্শনার্থীর পাশাপাশ পাঠকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে পছন্দের বই কিনেছিলেন তারা। প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজনকে উপহার দিয়েছেন পছন্দের বই!
কলাবাগান থেকে বইমেলায় আসা সানজিদা রাফা ও আরেফিন সোহাগ দম্পতি প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়ন থেকে আনিসুল হকের ‘কোনো এক মাকে’, জাভেদ হুসেন অনূদিত ‘মির্জা গালিবের সঙ্গে দেখা’, আসিফ নজরুলের ‘আমি আবু বকর’ ও সুমন্ত আসলামের ‘অর্ধেক তুমি অর্ধেক বনলতা সেন’— এই চারটি কিনে পরস্পর পরস্পরকে উপহার দিয়েছেন।
সানজিদা রাফা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিয়ের পর প্রথম বইমেলায় আসা। ধুলাবালি আর ভিড় এড়াতে আজকের দিনটা বেছে নিয়েছি। আমি ওর জন্য দুইটা বই কিনেছি, ও আমার জন্য দুইটা বই কিনেছে। লেখকদের অটোগ্রাফ আশা করেছিলাম। কিন্তু আজ এখন পর্যন্ত উনারা বইমেলায় আসেননি।’
নিরিবিলি পরিবেশের কথা মাথায় রেখে বোদ্ধা পাঠকরাও সোমবারের দিনটি বেছে নিয়েছেন। তারা বেছে নিয়েছেন নন-ফিকশন বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল-প্যাভিলিয়নগুলো। ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, ভ্রমণ, গবেষণার বই কেনার জন্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল), দিব্যপ্রকাশ, খান ব্রাদার্সের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল-প্যাভিলিয়নে তাদের আনাগোনা বেশি দেখা গেল।
ইউপিএল থেকে জয়া চ্যাটার্জীর ‘বাঙলা ভাগ হল’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১’, হাসিব আলী বর্ণা সম্পাদিত এশিয়ার নারী সাধকদের জীবন ও কবিতার ওপর গবেষণামূলক বই ‘গহীনের স্রোতধারা’ এবং ইউভ্যাল নোয়া হারারির ‘স্যাপিয়েন্স’ বইগুলো কিনতে দেখা গেল আজিমপুর থেকে বইমেলায় আসা লিটন কুমার বিশ্বাসকে।
ইউপিএলের প্যাভিলিয়নে দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় লিটন কুমার বিশ্বাসের। তিনি বলেন, ‘বইমেলা থেকে বই কেনার আলাদা একটা আনন্দ আছে। কিন্তু অতিরিক্ত ভিড়, ধুলাবালি অনেক সময় সেই আনন্দ মাটি করে দেয়। সে কারণে আজ মেলায় আসা। তারপরও বইমেলায় প্রচুর লোক দেখা যাচ্ছে। আর কিছু বই কিনে দ্রুত বাসায় ফিরব। মানুষের ভিড় এখন আর নিতে পারি না।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
অমর একুশে বইমেলা অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ দর্শনার্থীদের ভিড় বই বিক্রি বইমেলা বইমেলা ২০২৪