Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শহিদ মিনার নেই রাজশাহীর ৫৯% শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:০০

কাদিরগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহিদ মিনার, একুশে ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা জানাতে হয় অন্য কোথাও গিয়ে। ছবি: সারাবাংলা

রাজশাহী: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক নগরী রাজশাহী। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে আন্দোলনে প্রথম রক্ত ঝরেছিল এই নগরীতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সালাম-বরকতরা শহিদ হলে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হয়েছিল এই রাজশাহীতেই।

সেই রাজশাহী নগরী ও জেলার ৫৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই কোনো শহিদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ করে দেয়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই সেরকম কোনো আয়োজনও।

বিজ্ঞাপন

ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও অন্তত সরকারি সব বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার স্থাপন নিশ্চিত না হওয়াকে দুঃখজনক মনে করছে সচেতন মহল। তারা বলছেন, প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনসহ আমাদের জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কেই সহজে সচেতন করে তুলতে পারবে।

ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থ ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে রাজশাহী নগরীর মোহন পার্কে এক জনসভা আয়োজিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের দাবিতে সেটিই ছিল প্রথম কোনো জনসভা। এর ১০ দিন পরই ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহিদ হন সালাম-বরকতরা। সেই ভাষাশহিদদের স্মৃতিতে স্মরণীয় রাখতে প্রথম শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছিল রাজশাহীতেই। সেদিনই (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেলের এফ ব্লকের সামনে ইট-কাদা দিয়ে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটিই ছিল দেশে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ মিনার।

নম ভদ্রা স্কুলেও শহিদ মিনার নেই। ছবি: সারাবাংলা

ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে থাকা রাজশাহীর বিদ্যালয়গুলোতে শহিদ মিনার খুঁজে পাওয়াই দায়। রাজশাহী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার এক হাজার ৫৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৮১টিতে নেই শহিদ মিনার। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ হার আরও কম— ৯০৮টির মধ্যে শহিদ মিনার রয়েছে মাত্র ২৩২টিতে, অর্থাৎ ৬৭৬টিতেই নেই! সব মিলিয়ে এক হাজার ৯৬৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮০৮টিতে শহিদ মিনার আছে, নেই এক হাজার ১৫৭টিতে। সে হিসাবে জেলার ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা প্রায় ৮৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই শহিদ মিনার।

বিজ্ঞাপন

তথ্যে দেখা যায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে বাগমারায় সবচেয়ে কম শহিদ মিনার আছে। এই উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি ২২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১০টি আছে শহিদ মিনার। ১৬২টি সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে শহিম মিনার আছে ১২টিতে। সব মিলিয়ে ৩৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২২টিতে রয়েছে শহিদ মিনার, যা ৬ শতাংশেরও কম।

শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যালয়গুলোতে শহিদ মিনার না থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থের সংকট। কিছু কিছু বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার স্থাপনের মতো পর্যাপ্ত জায়গাও নেই। তবে অর্থ বরাদ্দ পেলে বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহিদ মিনার স্থাপন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।

বাগমারার মোহম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খন্দকার মো. জাহেদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘অর্থের অভাবে স্কুলে শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা থেকে অর্থ বরাদ্দ মিলছে না। তাই আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অস্থায়ী শহিদ মিনার বানিয়েছি। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব।’

উপজেলার চানপাড়া আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক নাজমা খাতুন বলেন, ‘বিদ্যালয় চত্বরে শহিদ মিনার স্থাপনের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসে।’

রেলওয়ে স্কুল, এর মতো অনেক বিদ্যালয়েই শহিদ মিনার স্থাপনের জায়গাও নেই। ছবি: সারাবাংলা

রাজশাহী নগরীজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, এর অধিকাংশেই নেই শহিদ মিনার। সাবিত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাবিত্রী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মসজিদ মিশন একাডেমি বালিকা শাখা, রেলওয়ে স্টেশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গৌরহাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাদিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, সেগুলোতে শহিদ মিনার নেই। এর মধ্যে কয়েকটিতে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্যও সেই পর্যাপ্ত জায়গা।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের শহিদ মিনারে যান শিক্ষকরা। আবার কখনো অস্থায়ী শহিদ মিনারেই করা হয় শ্রদ্ধা নিবেদন। ফলে শহিদ মিনার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা যেমন অস্পষ্ট, তেমনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিবসের তাৎপর্যও উপলব্ধি করতে পারে না শিশুরা।

মসজিদ মিশন একাডেমি বালিকা শাখার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিকা ইবনাত বলল, ‘আমাদের এই শাখায় শহিদ মিনার নেই। থাকলে আমরা স্কুলেই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম। শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের যেতে হয় বালক শাখায়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেভাবে দিবসগুলোতে আলাদা করে কোনো অনুষ্ঠানও করা হয় না।’

কাদিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহারা নাসরিন বলেন, স্কুল প্রাঙ্গণে শহিদ মিনার স্থাপনের জন্য জায়গা না থাকায় তো শ্রদ্ধা জানাতে অন্য স্কুলে যেতে হয়। আমাদের এই বিদ্যালয়ের খেলার মাঠও নেই।

জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার স্থাপনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা অর্থের অভাব। শহিদ মিনার নির্মাণে আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো বরাদ্দ পাই না। বরাদ্দ পেলে সব বিদ্যালয়ে আমরা শহিদ মিনার তৈরি করব।’

রাজশাহী জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সারাবাংলা/টিআর

একুশে ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহিদ মিনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর