মাতৃভাষায় ৩ জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষা ব্যাহত, অন্যদের সুখবর নেই
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:১৩
রাঙ্গামাটি: ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর ও স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ২০১৭ সালে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে সরকার। ওই বছর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে চাকমা, চারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি জনগোষ্ঠীর শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় মাতৃভাষায় রচিত প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির বই। ক্রমান্বয়ে এখন এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষার বই দেওয়া হচ্ছে।
সারাদেশে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে মাতৃভাষায় বই বিতরণ করা গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই শিক্ষাক্রমের আওতায় এসেছে কেবল কেবল চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুরা। এর বাইরে পাহাড়ের তঞ্চঙ্গ্যা, বম, ম্রো, খিয়াং ও পাংখোয়াসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় পাঠ থেকে বঞ্চিত। তাদের মাতৃভাষার শিক্ষা নিয়ে এখনো কোনো সুখবর নেই। ভাষা গবেষক ও শিক্ষাবিদরা পাহাড়ের সব নৃগোষ্ঠীর শিশুকেই মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিতের জন্য সরকারকে তাগাদা দিচ্ছেন।
এদিকে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দররবানে ২০১৭ সাল থেকেই চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুরা মাতৃভাষার বই পেলেও আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনার অভাবে শিক্ষকরা নিজেরাই মাতৃভাষায় পাঠদানে নিজেদের প্রশিক্ষিত করে তুলছে পারছেন না। মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য বিষয়ভিত্তিক আলাদা শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজনও মনে করছেন তারা। শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি যুগোপযোগী পরিবেশের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রম। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, কেবল নামমাত্র উদ্যোগ নিলেই হবে না। মাতৃভাষায় শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।
মাতৃভাষায় পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাঙ্গামাটি জেলাটি চাকমা জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এখানকার শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাকমার সংখ্যাই বেশি। তারাসহ মারমা ও ত্রিপুরা শিশুরাও ২০১৭ সাল থেকে মাতৃভাষায় বই পাচ্ছে। তাদের পাঠদানও হচ্ছে মাতৃভাষায়। কিন্তু এতদিনেও এসব শিশুদের পাঠে অগ্রগতি খুব একটা নেই। এসব শিশু নিজ নিজ ভাষার বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হতে পারলেও তাদের বেশির ভাগই বাক্য গঠন করতে পারছে না। অনেক শিক্ষক ভালোভাবে পারছেন না পড়াতেও। শহুরে এলাকার তুলনায় প্রান্তিক এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ প্রতিকূলতা আরও বেশি।
রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা দক্ষিণ কুতুকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডেবিট চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবাসিক বিদ্যালয় হওয়ায় আমাদের বিদ্যালয়ে অন্য ভাষাভাষী শিক্ষার্থীও রয়েছে। তবে শিক্ষার্থী থাকলেও তিন মাতৃভাষায় পাঠদান চালু হওয়ায় অন্য ভাষার শিশুরা বই পায় না। সাধারণত যেসব শিক্ষক জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শ্রেণি কার্যক্রমে পাঠদান করেন, তাকেই আবার মাতৃভাষার বই পড়াতে হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রমে জোর দেওয়ার কারণে মাতৃভাষার শিক্ষার ভালোভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়ে ওঠে না।’
এই প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, ‘মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত নয়। একটি ভাষার ওপর পাঠদানের জন্য একজন শিক্ষকের তিন-চার দিনের প্রশিক্ষণে কিছুই হয় না। অনেক শিক্ষক নিজেরাই সঠিকভাবে সব শব্দগুলো জানেন না, চিনতে পারেন না। আমি বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও বলেছি, মাতৃভাষার শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের সময় নিয়ে ভালোভাবে নিয়ম অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রয়োজনে পাড়াকেন্দ্রের মতো এলাকাভিত্তিক শিক্ষক রাখা যেতে পারে।’
রাঙ্গামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস (ডিপিইও) সূত্র জানায়, চলতি বছরও (২০২৪ শিক্ষাবর্ষ) জেলায় ২৮ হাজার ১৫৫ জন চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিক্ষার্থী মধ্যে মাতৃভাষার ৬৩ হাজার ৪৬৮টি বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক সাত হাজার ৯ জন, প্রথম শ্রেণির সাত হাজার ৪৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর সাত হাজার ১০৯ জন ও তৃতীয় শ্রেণির ছয় হাজার ৯৯৪ জন শিক্ষার্থী মাতৃভাষায় বই পেয়েছে।
চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা তিন ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের প্রাক-প্রাথমিকে বইয়ের সংখ্যা দুটি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বই দেওয়া হয় তিনটি করে। আর তৃতীয় শ্রেণিতে মাতৃভাষায় বই দেওয়া হয় একটি করে।
জনসংখ্যার দিক দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলায় মারমা ও ত্রিপুরাদের চেয়ে চাকমাদের বসবাস বেশি হওয়ায় এ নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীই বেশি। ডিপিই কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৩৬২ জন, ২০১৮ সালে ৩৫০ জন, ২০১৯ সালে ৩৪০ জন, ২০২২ সালে ২৭০ জন ও ২০২৩ সালে ৩৯৭ জন শিক্ষককে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় পাঠদানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছরে প্রশিক্ষণ দেওয়া মোট শিক্ষকের সংখ্যা এক হাজার ৭১৯ জন। তবে কোনো কোনো শিক্ষক একাধিকবারও প্রশিক্ষক নিয়েছেন। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭০৭টি। তবে এনজিও, কিন্ডারগার্টেন, পরীক্ষণ বিদ্যালয়সহ মোট প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক হাজার ৬৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিইও) হৃষীকেশ শীল বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রম চালু করেছে সরকার। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত চারটি শ্রেণিতে মাতৃভাষার বই দেওয়া হচ্ছে। রাঙ্গামাটি জেলায় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান করা হচ্ছে। এখানে অন্য ভাষাভাষী শিশুরা থাকলেও তাদের মাতৃভাষায় পাঠদানের বিষয়ে এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্তের খবর আমরা পাইনি।’
শিশুদের মাতৃভাষায় লেখাপড়ার অগ্রগতি সম্পর্কে হৃষীকেশ শীল বলেন, ‘শিশুরা নিজ ভাষার অক্ষর চিনতে পারছে। রাঙ্গামাটি জেলার মধ্যে জুরাছড়ি উপজেলাসহ কয়েকটি এলাকায় মাতৃভাষায় পাঠদানে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। আমরা সরেজমিন পরিদর্শন করেও দেখেছি। সুনির্দিষ্টভাবে কোনো এলাকায় অগ্রগতি কম থাকলে আমরা সে এলাকায় বিশেষভাবে নজর দেবো। শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাতৃভাষার শিক্ষায় পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকলেও অনেক বিদ্যালয়ই শিক্ষার্থীদের জানার পরিধি যাচাইয়ে ১০ নম্বর ওপর মূল্যায়ন পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।’
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ২০১৭ সালে পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পাঠদানের যে উদ্যোগ নিলে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হলেও এই উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। সোজা কথায় কোনো সাফল্য নেই। সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক করা হয়নি। কেবলমাত্র বই ছাপানো আর বিতরণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না। প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। মাতৃভাষায় শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের এমনভাবে পড়াতে হবে যেন তাদের মনে গেঁথে যায়। শিক্ষার্থীরা যেন তার নিজ ভাষাকে চিনতে পারে, লিখতে পারে।’
নিরূপা দেওয়ান আরও বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম পাহাড়ে প্রথম তিনটি মাতৃভাষায় পাঠদান শুরু হলেও ক্রম্বান্বয়ে অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর শিশুদের এই কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ দেখছি না। তিন জনগোষ্ঠীর শিশুরা এই শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এলেও অন্যরা বঞ্চিত রয়ে গেল। তাদের মাতৃভাষায় শেখার-পড়ার অধিকার রয়েছে। মাতৃভাষায় পাঠদান নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।’
ত্রিপুরা ভাষার গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে যে বইগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলোয় ঠিক মতো পড়ানো হচ্ছে না। শিক্ষকদের জন্য ভালো প্রশিক্ষণ নেই, কোনো দিক-নির্দেশনা নেই। এভাবে তো সাফল্য আসে না। ২০১৭ সালে সমতল ও পাহাড় মিলে পাঁচটি ভাষায় শুরু হলেও ২০১৮ সাল থেকে আরও ছয়টি ভাষায় মাতৃভাষায় পাঠদান শুরুর কথা ছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবে আশার কথা, এ বছর মাতৃভাষার শিক্ষকদের জন্য শিক্ষক ম্যানুয়েল হচ্ছে। এটি হলে শিক্ষকদের জন্য দিকনির্দেশনা থাকবে ও ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তখন মাতৃভাষায় শিক্ষাক্রমের অগ্রগতি দেখা যেতে পারে।’
সামনে পাহাড়ের তঞ্চঙ্গ্যা, বম ও ম্রো জাতিগোষ্ঠী এবং সমতলের মৈতৈ মনিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ও খাসী জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান শুরুর কথা হয়েছে বলে জানান বিকাশ ত্রিপুরা। বলেন, ‘আগামী বছরে যদি এ সিদ্ধান্তে আসা যায়, সেক্ষেত্রে ২০২৬ সাল থেকে তারা মাতৃভাষায় পাঠদানের আওতায় আসবে।’
সারাবাংলা/টিআর
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা ত্রিপুরা মাতৃভাষায় পড়ালেখা মাতৃভাষায় পাঠদান রাঙ্গামাটি