দর্শনার্থীশূন্য বরকত স্মৃতি জাদুঘর, ঢেকে থাকে ব্যানারের আড়ালে
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:১৫
ঢাকা: রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ঢাকা পড়ে গেছে ভাষাশহিদ আবুল বরকতের স্মৃতিতে গড়ে তোলা শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েই জাদুঘরের আশপাশ ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। আর সেই ব্যানারের দাপটে জাদুঘরের নামফলকটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়রা জানালেন, প্রায় সারাবছরই এরকম নানা উপলক্ষে ব্যানার-পোস্টারের আড়ালেই পড়ে থাকে জাদুঘরটি।
এদিকে গত এক বছরে জাদুঘরের তেমন কোনো অগ্রগতিও হয়নি। প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি কাউকে। একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহিদ দিবস সামনে রেখে কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হলেও অযত্ন-অবহেলার ছাপ এখনো রয়েছে জাদুঘরের এখানে-সেখানে। জাদুঘরটিতে দর্শনার্থীর সংখ্যাও প্রায় শূন্যের কোটায়।
ভাষাশহিদ আবুল বরকতের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পলাশী মোড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ভাষাশহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। জাদুঘরটির আকার খুবই ছোট। সংগ্রহশালায় নেই খুব বেশি স্মৃতিচিহ্নও।
সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জাদুঘরে গিয়ে এই প্রতিবেদক মাত্র একজন দর্শনার্থীর দেখা পান। দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একজন ভারপ্রাপ্ত প্রদর্শক ও মাত্র তিনজন অফিস সহকারী দিয়ে জাদুঘরটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় বছর দুই আগে জাদুঘরের গাইড (প্রদর্শক) মারা গেছেন। সেই পদে এখনও নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আবার অবৈতনিক হওয়ায় জাদুঘরের পরিচালকও সেখানে নিয়মিত পা রাখেন না! সবমিলিয়ে জাদুঘরটি দর্শনার্থী তো বটেই, সবকিছু মিলিয়েই প্রায় জনশূন্য। এটিই এখানকার নিয়মিত চিত্র!
সোমবার দুপুরে জাদুঘর ও আশপাশের এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জাদুঘরের ঠিক নামফলকের পাশেই বড় বড় ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমের শ্রদ্ধাঞ্জলির ব্যানার এমনভাবে ঝুলছে, দূর থেকে শহিদ বরকত স্মৃতি জাদুঘরের নামফলকটিই দেখা যায় না।
লালবাগ-চকবাজার থানার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদ্য সাবেক সহসভাপতি দিল মোহাম্মদ গণির ব্যানারেও একই অবস্থা। এসব ব্যানারে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর।
জাদুঘরের ভেতরে ঘুরে দেখা গেল, ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। একজন কর্মী জাদুঘরের ঠিক প্রবেশমুখের গেট পানি দিয়ে পরিষ্কার করছেন। টাইলসসহ আরও অনেক কিছুই পরিষ্কারের কাজ চলছিল।
জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য সবসময় উন্মুক্তও থাকে না। ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ থাকে। অন্য দিনগুলোতেও খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে আবার দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি। সব মিলিয়ে দিনে মাত্র ৫ ঘণ্টা জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
জানতে চাইলে জাদুঘরের ভারপ্রাপ্ত প্রদর্শক এনামুল হক সারাবাংলাকে বলেন, জাদুঘরে লোকবলের সংকট রয়েছে। মাত্র তিনজন নিরাপত্তা কর্মী রয়েছেন। তারা তিন শিফটে ভাগ হয়ে কাজ করেন। ক্লিনার নেই, বাগানের মালি নেই।
একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখে ধোয়া-মোছার কাজ চলছিল জাদুঘরটিতে। যে কারণে এর পরিবেশ এখন আগের চেয়ে অনেকটাই পরিচ্ছন্ন। এনামুল হক বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির আগে প্রতিবছরই জাদুঘরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। ধোয়া-মোছা ও রঙের কাজ কাজ করা হয়। এবারও ধোয়া-মোছার কাজ চলছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে জাদুঘরের ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর করতে চায় বলে শুনেছি। এখানে শুধু বরকতের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে, বড় আকারে ঢাবির পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হওয়ার কথা। তাই নতুন করে লোকবলও নিয়োগ হচ্ছে না।
জাদুঘরের নিরপত্তাকর্মী শাহিন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা তিনজন তিন শিফটে কাজ করি। কোনো কারণে ওয়াশরুমে যাওয়া বা অন্য কাজ করতে গেলে জাদুঘর দেখার মতো কেউ থাকে না। তবে বেশির ভাগ সময়ই দর্শনার্থী থাকে না। কখনো কখনো হয়তো দলবেঁধে একসঙ্গে অনেকে আসে।
জানতে চাইলে ঢাবির ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ভাষাশহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রশালার পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো দিবস এলেই এই জায়গাটিতে রাজনৈতিক দলের ব্যানার-পোস্টার লাগানো হয়। আমাদের কর্মীরা বাধা দিতে গেলে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। তারা একসময় প্রতিহিংসার স্বীকারও হয়েছে। ফলে আমরা চাইলেও তাদের ব্যানার-পোস্টার টানানোতে বাধা দিতে পারি না।’
ঢাবির এই অধ্যাপক জানান, জাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি শিগগিরই প্রকাশ হওয়ার কথা রয়েছে। ঢাবি প্রশাসন এর অনুমোদন দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১২ সালের ২৫ মার্চ যাত্রা শুরু বরকত স্মৃতি জাদুঘরের। এর পরিচালক ঢাবি অধ্যাপক ড. দেলোয়ার সারাবাংলাকে আরও বলেন, ‘সাধারণত এই অল্প জায়গায় জাদুঘর হয় না। আর এখানে ভবনটি এমনভাবে করা হয়েছে যে একে ভবিষ্যতে বর্ধিতও করা যাবে না।’
খুব দেরিতে জাদুঘরটি শুরু হয়েছে বলে সেখানে শহিদ বরকতের খুব বেশি স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহে রাখা সম্ভব হয়নি বলেও জানান এই ঢাবি অধ্যাপক। বললেন, ভবিষ্যতে জাদুঘরটিতে ডিজিটাল ডিসপ্লে স্থাপন করা হবে, যেখানে বরকতের বিভিন্ন ছবি ও নানা স্মৃতিচিহ্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হবে।
ড. দেলোয়ার বলেন, ‘২০১২ সালে এই জাদুঘরটির যাত্রা শুরু। আমরা তো অনেক পরে শুরু করেছি। যেহেতু জাতীয় জাদুঘর আগে যাত্রা শুরু করেছে, তারা সব (স্মৃতিচিহ্ন) পেয়েছে। এটা তো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। বরকতের লেখা আরও কিছু চিঠি আমরা এখানে যুক্ত করব। ভাষা আন্দোলনের ওপর তিনটি এমফিল ও তিনটি পিইচডি গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পিএইচডি গবেষণা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে,. বাকি দুটি ঢাবি থেকে। যারা গবেষণা করতে আসেন, তারা এই পাঠাগার ব্যবহার করেন।’
জাদুঘরে বাবাকে লেখা বরকতের চিঠি, তার শিক্ষাগত যোগ্যতার বিভিন্ন সনদের অনুলিপি ও দুর্লভ সব ছবি সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের খবর রয়েছে— এমন পত্রপত্রিকার কিছু কাটিংও সংরক্ষণ করা হয়েছে জাদুঘরটিতে। কিছু স্মৃতিচিহ্ন, হাতঘড়ি ও একুশে পদকও সংরক্ষিত রয়েছে।
দোতলা ভবনের নিচতলায় আবুল বরকতের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্রও রয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ভাষা শহিদ আবুল বরকতের স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি সার্টিফিকেটের অনুলিপি রয়েছে। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে পাস করেছিলেন তিনি। বরকতের ব্যবহৃত তিনটি কাপ ও পিরিচ সংরক্ষিত রয়েছে। বরকত ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) পেয়েছিলেন, সেটিও সংরক্ষিত আছে সেখানে। এ ছাড়া ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের কপি রয়েছে এই জাদুঘরে। জাদুঘরের দোতলায় রয়েছে একটি লাইব্রেরি, সেখানে ভাষা শহিদদের ওপর লেখা বই রয়েছে চার শতাধিক।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
বরকত জাদুঘর ভাষাশহিদ বরকত শহিদ আবুল বরকত শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর