টেকনাফের অরণ্যে অপহরণকারীদের ‘রাজত্ব’, টার্গেট স্কুল শিক্ষার্থী
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৩০
কক্সবাজার: টেকনাফের উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ের গহীন অরণ্য এখন অপহরণকারীদের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। শুধু বাহারছড়া ইউনিয়নেই গত তিন বছরে ৪৯ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলেও অনেকে অপহরণকারীদের চাহিদা মেটাতে না পারায় আর ফিরতে পারেনি নিজ পরিবারের কাছে। সম্প্রতি বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুলশিক্ষার্থীদের অপহরণ। সম্প্রতি এক স্কুল থেকেই অপহরণ হয়েছে চার শিক্ষার্থী। এই ভয়ংকর থাবা থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা চাইছেন আতঙ্কিত এলাকাবাসী।
টেকনাফের বাহারছড়ার অপহরণ চক্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে সম্প্রতি এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলশিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণিপেশার স্থানীয় তিন শতাধিক বাসিন্দা মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ের ঘন অরণ্যে থাকা এই অপহরণকারীরা খুবই ভয়ংকর। তারা দিন-দুপুরে অপহরণ করে নিয়ে যায় গহীন অরণ্যে। পরে পরিবারের কাছে ফোন করে চায় মুক্তিপণ। চাহিদা অনুযায়ী মুক্তিপণ দিতে পারলে পরিবারের কাছে ফেরত আসে, না দিতে পারলে আর অপহৃতদের হদিস মেলে না। অপহরণের শিকার অনেকের লাশ পাওয়া গেছে জঙ্গলের ভেতরে। আবার অপহরণের পর অনেকের কোনো খবরই পাওয়া যায়নি।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বনরক্ষীরা পর্যন্ত রক্ষা পাচ্ছেন না অপহরণকারীদের হাত থেকে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। প্রতিবাদ করলেই অপহরণের ঝুঁকি— এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা। তারা বলেন, অপহরণকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিচিতি ব্যক্তির ছদ্মবেশে এলাকাতেই অবস্থান করেন। একের পর এক অপহরণের ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও অসন্তুষ্ট এলাকার লোকজন।
টেকনাফের গত বছরের অপহরণের একটি ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়। কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফে ছোট ভাইয়ের পাত্রী দেখতে গিয়ে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন তিন বন্ধু। পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার হয়। মৃত্যুর আগে মুক্তিপণের জন্য ওই তিন বন্ধুকে মারধরের ভিডিও সামাজিকযোগাযোগ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এ ছাড়া অপহৃত সিএনজি অটোরিকশাচালকের গলিত লাশ উদ্ধার এবং টেকনাফে পাঁচ কৃষক অপহরণ, যাদের মধ্যে তিনজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধারের ঘটনাও আলোচিত হয়। ওই কৃষকদের অপহরণ করা হয়েছিল টেকনাফের হ্নীলার পানখালী ও মরিচ্যাঘোনা এলাকা থেকে। অন্যদিকে টেকনাফে বন পাহারা দেওয়ার সময় তিন বন প্রহরীকে অপহরণ করা হয়েছিল, যাদের কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া পাহাড়ি এলাকায় মাছ শিকার করতে যাওয়া তিন শিক্ষার্থীসহ আটজনকে অপহরণের ঘটনাও আলোচিত হয়।
সর্বশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি আব্দুল আমিন (১৪) নামে এক শিক্ষার্থী অপহৃত হয়। সে টেকনাফের বাহারছড়া মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আব্দুল আমিন বাহারছড়ার মাথা ভাঙ্গা এলাকার মোক্তার আহমদের ছেলে। এই অপহরণের ঘটনায় শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
অপহৃত আব্দুল আমিনের বাবা মোক্তার আহম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন পাহাড়ের পানের বরজে (বাগান) পান তুলতে গিয়েছিল আব্দুল আমিন, তার মা, বোন ও ভাইসহ চারজন। হঠাৎ অপহরণকারীরা তাদের ঘিরে ফেলে এবং আমার ছেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওই সময় ডাকাতরা ফাঁকা গুলি করে।’
মুক্তিপণ পরিশোধের পর গত রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বাড়ি ফিরেছে এক সপ্তাহ আগে অপহরণ হওয়া মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির স্কুল শিক্ষার্থী আব্দুল আমিন।
মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণ এই এলাকার স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মারিশবনিয়া থেকেই ১৩ জন অপহরণ হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন স্কুল শিক্ষার্থ। ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইছে না। প্রশাসন আন্তরিক হলে হয়তো এই অপরাধ বন্ধ হতো। পাশাপাশি এই অপহরণ সিন্ডিকেটের সঙ্গে এলাকার মধ্যে যেসব লোক জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘একের পর এক স্কুলশিক্ষার্থী অপহরণ হওয়ায় লোকজন তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইছে না। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা করছি, আর কোনো আব্দুল আমিনকে যেন অপহরণের শিকার হতে না হয়। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ কামনা করছি।’
টেকনাফ বাহাছড়া ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ ফরিদ উল্লাহ্ জানান, ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৪৯ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন এই ইউনিয়ন থেকে। এর মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। অনেকের কোনো খবরই পাওয়া যায়নি। বাকিদের বেশির ভাগকেই মুক্তিপণ দিয়েই উদ্ধার করা হয়েছে। সাত বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউই অপহরণকারীদের হাত থেকে বাচঁতে পারছে না।
ফরিদ উল্লাহ্ বলেন, অপহরণের ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসনের কাছ থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাওয়া যায় না। পরে পরিবারের লোকজন মুক্তিপণ দিয়েই তাদের ছাড়িয়ে আনে। অনেকে মুক্তিপণ দিতে না পারায় সন্তান-ভাই অথবা স্বামীকে হারাচ্ছেন। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, অপহরণের বিষয়গুলো প্রশাসন অবগত। অপহরণের খবর পাওয়া সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকদের নিয়ে প্রশাসন অভিযান চালায়। এরই মধ্যে অনেককে উদ্ধারের পাশাপাশি অপহরণকারীদের আটক করা হয়েছে। তবে অনেক সময় অপহরণের ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যা অনেক অভিভাবকরা বুঝে উঠতে পারেন না। আবার অনেক অভিভাবক অভিযোগও করেন না।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, অপহরণ ঠেকাতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে খুব শিগগিরিই অপহরণ প্রতিরোধে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে বলে জানান তিনি।
সারাবাংলা/এমও