Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উচ্চস্বরে গান, অহেতুক ভিড়— কীসের মেলা বোঝা দায়!

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:৪৫

চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের সিআরবিতে চলছে একুশের বইমেলা। তবে আয়োজনে অব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে লেখক-পাঠকদের মধ্যে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।

বইমেলার ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে শিশু কর্নার। প্রবেশপথ আলাদা। সেখানে রাখা আছে শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইড। ৪০ থেকে ৫০ টাকার বিনিময়ে শিশুরা পাচ্ছেন রাইডে চড়ার সুযোগ। বইমেলায় রাইড কেন?— এমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। জায়গার সংকীর্ণতার কারণে শিশু কর্নারও অস্বস্তি তৈরি করেছে।

বিজ্ঞাপন

মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। তবে তা নিয়ে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাজানো হচ্ছে উচ্চস্বরে গান, অনেকসময় বাজে হিন্দি গানও। আছে হাল আমলের সেলফি সংস্কৃতি আর কথিত ইউটিউবারদের বিড়ম্বনাও। অনেকেই স্টলে ভিড় করছেন ছবি তোলা আর ভিডিও করার জন্য। বই কেনা কিংবা পাঠক-লেখকের চিরায়ত যে সম্মিলন, সেটা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে লেখক-পাঠকদের জন্য বইমেলা তার চিরায়ত আবহ তৈরি করতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।

মেলা কর্তৃপক্ষ বলছে, মেলায় প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেখান থেকে আওয়াজ যাওয়া স্বাভাবিক। তবে অন্য জায়গা থেকে সাউন্ডবক্সের আওয়াজ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মেলায় বই কিনতে আসা পাঠকরা বলছেন, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সিআরবি বইমেলা করার জন্য চমৎকার একটি স্থান। কিন্তু ভবিষ্যতে আয়োজকদের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে আরও সতর্ক হতে হবে।

কলেজ শিক্ষক কাইয়ুম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বইমেলায় আমি প্রতিবছর আসি। নিজের জন্য বই কিনি, বন্ধুবান্ধব, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যও কিনে দিই। সিআরবিতে বইমেলা হচ্ছে, এটা ভালো লাগছে। তবে পরিবেশটা আগর মতো আর নেই। এত সাউন্ড, মনে হচ্ছে কোনো পণ্যমেলায় এসেছি।’

বিজ্ঞাপন

মুনতাহা নাসির নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু কর্নারের প্রয়োজন ছিল না। বইমেলাকে বাণিজ্যমেলা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।’

কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলায় লেখকদের জন্য এবার আলাদাভাবে কোনো স্পেস রাখা হয়নি, এটা আমাদের জন্য দুঃখের বিষয়। সেটা অবশ্য ক্ষমা করা যায়। কারণ, এবার মেলা নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা ছিল। কম সময়ের মধ্যেই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় পাঠকরা বই পড়তে ও কিনতে আসেন। কিন্তু শব্দ দূষণ হলে পাঠকরা বইয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন না। বইমেলায় শিশুদের জন্য আলাদা পার্ক করার কি দরকার? সেখানে যেভাবে গান ছাড়া হয় সেটার জন্য পুরো মেলার পরিবেশ নষ্ট হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেলায় অনেক বয়স্ক লোক আসেন। নারী ও পুরুষও আসেন। সিটি করপোরেশন থেকে এখানে একটি ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার রাখার প্রয়োজন ছিল। বইমেলায় এসে এজন্য অনেকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। আগামীবার থেকে কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে।’

কবি রিমঝিম আহমেদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এবারের বইমেলাকে একটা জঞ্জাল মনে হলো। লোকে লোকারণ্য, অথচ বেশিরভাগই এমনি গেছে। খাবারের দোকান, শো-পিসের দোকান ইত্যাদির মাঝে বইয়ের স্টল বোধ হয় কম! মঞ্চের গান শুনে মনে হয়েছে একটি বিয়ে বাড়ি। আর ধুলার কথা কী বলব, নিঃশ্বাস নেয়া দায়।’

তিনি বলেন, ‘তার ওপর শিশুদের নাম করে একপাশে একটা পার্ক বসানো হয়েছে। সেখানে দোল খেতে যাওয়া লোকজন দেখে বৈশাখী মেলা ভেবে ভ্রম হয় ! জিমনেসিয়াম মাঠ থেকে বইমেলাটা ঠেলে সিআরবিতে নিয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে এটাকে ঠেলতে ঠেলতে শহরের একপ্রান্তে পতেঙ্গা সৈকতে নিয়ে ছেড়ে দেবে। মানুষ বইমেলায় গিয়ে সমুদ্র দেখবে আর বইয়ের দোকানে যারা কাজ করে তারা মাছি মারবে। এত এলোমেলো বইমেলা আমার জন্মে দেখিনি!’

এদিকে শিশু কর্নারের পাশেই রয়েছে বেশকিছু বইয়ের স্টল। শিশুদের বই প্রকাশ করে এমন প্রকাশনা সংস্থার স্টল রয়েছে সে জায়গায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– নন্দন প্রকাশন, কিডস পাবলিকেশন্স, কথা বিচিত্রা প্রকাশনী, শালিক প্রকাশন, জনতা প্রকাশন, ঝিলমিল, ফুলঝুরি, রানা প্রকাশনী, শিশু কিশোরদের বইয়ের ভুবন এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। তবে গেটের অপর পাশে রয়েছে সত্যায়ন প্রকাশন। ধর্মীয় লেখকদের বই বিক্রি হয় এ প্রকাশনা স্টল থেকে।

নন্দন প্রকাশন’র প্রতিনিধি রওনক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবসময় এখানে নানা রকম গান বাজানো হয়। প্রথমে হিন্দি গান চালানো হতো। অভিযোগ দেওয়ার পর হিন্দি গান বন্ধ করেছে। তবে বিভিন্ন রকম মানহীন বাংলা গান ছাড়া হয়। পাঠক থেকে শুরু করে সবাই এ নিয়ে বিরক্ত।’

সত্যয়ন প্রকাশনীর এক বিক্রয় প্রতিনিধি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত জোরে গান বাজানো হয় যে আমরা পাঠকদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। অনেকে বিরক্ত হয়ে আমাদের দোকানের দিকেও আসেন না। আমরা মেলা কমিটিকে এ বিষয়ে জানিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নেবে বলে জানালেও এখনও কিছু করতে দেখিনি।’

চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের সভাপতি সাহাব উদ্দিন হাসান বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা অনেকের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছি। মেলার কর্তৃপক্ষও বিষয়গুলো নিয়ে অবগত আছেন। আমরা ওখানে গিয়ে তাদের মানা করেছি হিন্দি গান না চালাতে। এরপর তারা আর চালায় না। যদি উচ্চস্বরে গান বাজায় তাহলে মেলা কর্তৃপক্ষেকে আমরা আবার অভিযোগ দেবো।’

জানতে চাইলে শিশু কর্নারের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ ইমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হিন্দি গান বন্ধ করে দিতে বলার পর আর বাজাই না। এখন বাংলা গান চলে।’ কেন গান চালাতে হবে?— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাইডের সঙ্গে গান না চললে শিশুরা আনন্দ পায় না, মজা পায় না। আর গান ছাড়লেও সেটা এখন খুব কম ভলিউমে।’

চসিকের শিক্ষাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও বইমেলা পরিষদের আহ্বায়ক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহম্মেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘লেখকদের জন্য ওপরে কর্নার আছে। কিন্তু সেখানে কেউ যায় না। মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু কর্নারও আছে। লেখকরা ওখানে না গেলে আমাদের তো কিছু করার নেই। আর বইমেলায় তো শুধু বইয়ের দোকান দিলে হবে না। শিশুরা কোথাও গেলে এদিক-ওদিক যেতে চায়, ঘুরতে চায়। তাদের কথা চিন্তা করে শিশুকর্নার করা হয়েছে।’

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

চট্টগ্রাম বইমেলা বাণিজ্য মেলা বোঝা দায়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর