‘আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে জাবি’
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:১০ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৪৯
ঢাকা: ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মোড় ‘অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি—আন্দোলন দমন করতেই বঙ্গবন্ধুর নাম অপব্যবহার করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আন্দোলনের মূলস্রোতকে ঘুরিয়ে দিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের টাকার ভাগবাটোয়ারার পথ সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা এ সব কথা বলেন।
ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধুর গ্রাফিতি মুছে’ একটি প্রতিবাদী দেয়ালচিত্র আঁকার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী অমর্ত্য রায় ও ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলীকে একবছরের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে এই দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সাভারের আশুলিয়া থানায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা দায়ের করে। প্রশাসনের এমন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশটির আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এই দুই শিক্ষার্থীকে দেওয়া বহিষ্কারাদেশ ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তারা। এ সময় তারা ‘অন্যায্য বহিষ্কার প্রত্যাহার কর’, ‘গ্রাফিতি আঁকার দায়ে বহিষ্কারাদেশ বাতিল কর’, ‘ছাত্রনেতাদের বহিষ্কারাদেশ বাতিল কর’সহ বিভিন্ন লেখা-সম্বলিত প্ল্যা-কার্ড প্রদর্শন করেন।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৩তম আবর্তনের সাবেক শিক্ষার্থী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সুন্দর দেয়াললিখন হতো। দেয়াললিখন নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। যখন মোবাইল ছিল না, তখন অনেকেই ক্যামেরায় ছবি তুলে নিয়ে যেতেন। ১৯৯৬ সালের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় আধিপত্য শুরু হলো। এখন উপাচার্যদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।’
তিনি বলেন, ‘৯৬ এর পর থেকে একজন উপাচার্যও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণমেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। বর্তমান উপাচার্যের আগেরজন পেরেছেন শুধু। কারণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির ছায়া তার ওপর ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শতশত কোটি টাকার টেন্ডার হয়। আগে কেবল তিনটি হল ছিল। এখন ২২টি হল আছে। এইগুলোর কাজ নিয়ে মারামারি-কাটাকাটি হয়েছে তাদের মধ্যে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক সমিতিও এগুলোর টেন্ডার থেকে ভাগ পায়। ভাগাভাগির এই রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকে এ অবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র একটি ইস্যুকে ঘুরিয়ে দিতে অন্য ইস্যু বাজারে আনে। ঠিক একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর প্রশাসনও একই কাজ করছে। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে তারা দুজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. মাসুদ ইমরান নান্নু বলেন, ‘একটি রাষ্ট্রে কেন গ্রাফিতি মোছা যাবে না? অথচ এমন কোনো আইন নেই যা এই ধরনের গ্রাফিতিকে রক্ষা করবে। আমরা এর আগেও সুন্দর সুন্দর গ্রাফিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি।’
জাহাঙ্গীরনগরে নূর হোসেনের একটি গ্রাফিতি ছিল। ৯০ এর আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভূমিকার কথা এটি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিতো।
তিনি বলেন, ‘গ্রাফিতি একটি চলমান অবস্থা। যারা গ্রাফিতি করেন, তারাও আশা করেন না যে সেটি সবসময় থাকবে। অমর্ত্য ও ঋদ্ধ যে কাজ করেছে, সেটি যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে আমিও একই অন্যায় করতে চাই। শাহবাগে দাঁড়িয়ে আমি একথা বলে গেলাম। আমি এমন অপরাধ বারবার করতে চাই।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৯তম আবর্তনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তন্ময় ধর বলেন, ‘বর্তমান সময়ে শিল্প সংস্কৃতির উপর খড়্গ নেমে আসছে। এই ডিজিলাইজেশনের যুগে এসে কার্টুন আঁকার দায়ে মামলা হচ্ছে। ঋদ্ধ ও অমর্ত্যকে কেন তাদের বহিষ্কার করা হলো, কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো, সে প্রশ্ন আমরা করতে চাই!’
তিনি বলেন, ‘তারা এদের কেন এত ভয় পায়? তাদের যে ভাগভাটোয়ারার কাজ, সেখানে এই দুইজন বাধা দিয়েছে। অন্যতায় ধর্ষণ ঘটনায় উত্তাল পরিস্থিতির ঘটনা ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো কারণ নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাব্য কৃতিকা বলেন, ‘যে দেওয়ালের গ্রাফিতি নিয়ে এত সমস্যা, এই দেওয়ালে গত ৮ বছরে ৪/৫টি চিত্র ছিল। সময়ের সাথে সাথে চিত্র পাল্টানো হয়। ২০১৯ সালে সেখানে তৎকালীন উপাচার্যকে নিয়ে একটি ক্যারিকেচার ছিল। আমরা জানি, সেই ক্যারিকেচার নিয়ে অনেকের সমস্যা ছিল। পরে সেখানে বঙ্গবন্ধুর চিত্র আঁকে সেসময়কার ছাত্রলীগ।’
তিনি বলেন, ‘দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছিল, সেসময় সব শিক্ষকই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের এবারের ঘটনাটি কোনো ফরমাল ব্যাপার ছিলো না।এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অথচ এটিকে ভিন্ন একটি মোড় দেওয়া হয়েছে।’
৩৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থী এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌমিত্র জয়দ্বীপ বলেন, ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার মতো করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার একটি প্রতিফলন হলো প্রশাসনের এই উদ্যোগ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের বাইরেও বিকল্প ছায়া প্রশাসন কাজ করে। এখানে ৭৩ এর অধ্যাদেশের কোনো বালাই নেই। আজকে যে অরাজকতা জাহাঙ্গীরনগর শুরু করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় দুজন ছাত্রনেতাকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ এটি খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাধান করা যেত।’
তিনি বলেন, ‘একই সিন্ডিকেটে একজন শিক্ষককে যৌন নির্যাতনের অপরাধে এবং দুজন শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই প্লেকার্ডে এই ধরনের ঘটনা আমরা মানতে পারছি না।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী অনিরুদ্ধ দাস অঞ্জন বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরের মুক্ত পরিবেশের গলা টিপে ধরা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে দফায় দফায় আন্দোলনে নামতে হয়। জাহাঙ্গীরনগরে আগে পাখি গান গাইত, এখন গায় না। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবাধে লুটপাট চালাচ্ছে। অবাধে ধর্ষণ চলছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের চিরায়ত পথ বেঁছে নিয়েছে। তারা দুজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে। প্রশাসনকে আমি বলব—রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রদ্রোহ—এইগুলা পুনরায় পাঠ করবেন আপনারা।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী কাজল সিদ্ধান্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ইউল্যাবের শিক্ষক অলিউর সান, ২৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী সোহেল জাফর, সাদিয়া ফেরদৌস, অনিন্দ্য আরিফসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কিছু শিক্ষার্থী অংশ নেন।
সারাবাংলা/আরআইআর/একে