নিষ্প্রাণ আরিচা-কাজিরহাট নৌ রুট, ফাঁকা টার্মিনাল
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৭
মানিকগঞ্জ: বছর তিনেক আগে চালু হয়েছিল আলোচিত আরিচা-কাজিরহাট নৌ রুটে ফেরি সার্ভিস। ঘাটসংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজনের ধারণা ছিল ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে নিষ্প্রাণ আরিচা ঘাট ফিরে পাবে প্রাণচাঞ্চল্য। কিন্তু গত তিন বছরে সেই ধারণার সঙ্গে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিন থেকে ৪টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপারের ব্যবস্থা থাকলেও রয়েছে তীব্র যানবাহন সংকট। প্রতিদিন অল্প কিছু ট্রাক পারাপার হলেও যাত্রীবাহী যানবাহনের দেখা মেলে না। ফলে সকাল থেকে রাত অবধি ঘাট এলাকা থাকে একেবারেই ফাঁকা। দুই তিন ঘণ্টা পরপর একটি করে ফেরি আরিচা ঘাট থেকে ছেড়ে যায় শুধুমাত্র ট্রাক নিয়েই।
বিশাল জায়গা জুড়ে ট্রাক টার্মিনাল স্থাপন করা হলেও সেখানে অধিকাংশ সময় থাকে ফাঁকা। এছাড়া বাস টার্মিনালে বাসের অভাবে বিরাজ করে শুনশান নিরবতা। সরেজমিনে গত শুক্রবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এমন দৃশ্য দেখা গেছে আরিচা ফেরি ঘাটে।
যানবাহন সংকটের এই অবস্থায় ফেরিঘাটে প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাক থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পাবনার কাজিরহাট প্রান্তে এ অভিযোগ বিস্তর। এছাড়া আরিচা ফেরিঘাটের প্রাণ ফিরে না আসায় সেখানকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ছোট বড় ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে।
আরিচা ফেরি ঘাটের ট্রাক টার্মিনালের সামনের অপরপাশে টিন এবং পলিথিনের ছাউনিতে খাবার হোটেল দিয়েছে মোহাম্মদ জামাল শেখ নামে এক ব্যক্তি। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এই ঘাটেই কাটাচ্ছেন। খাবার হোটেল থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে বর্তমানে তার সংসারের খরচ চালাতে কষ্ট হয় । হোটেল ব্যবসায় মন্দা থাকায় তিনি ভালো নেই বলে জানালেন।
তিনি জানান, একসময় আরিচা ঘাট ছিল দেশের উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম। ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হয়ে যাওয়ার দুই বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায় আরিচা-কাজিরহাট নৌ রুটের ফেরি চলাচল। এরপর ফেরি ঘাটটি স্থানান্তর করা হয় পাটুরিয়ায়। ঘাট স্থানান্তর হওয়ার পর ব্যবসায় ধস নেমে আসে। কারণ এই পথ দিয়ে উত্তর অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত একেবারেই কমে যায়।
তিনি আরও জানান, বছর তিনেক আগে পুনরায় আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরু হওয়ায় এক বুক আশা জেগে উঠেছিল। কিন্তু যাত্রীবাহী বাস নেই, কিছু ট্রাক পারাপার হলেও সে আশায় গুঁড়েবালি।
মো. জামাল শেখের মতো এই আরিচা ঘাটে অসংখ্য খুদে চায়ের দোকান, খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের দিনকালও ভালো যাচ্ছে না যানবাহন ও যাত্রী সংকটের কারণে।
এসময় কাজিরহাট থেকে সবেমাত্র আরিচা ঘাটে পৌঁছেই অভিযোগ নিয়ে হাজির হন কয়েকজন ট্রাক চালক। তাদের অভিযোগ, ছোট, মাঝারি এবং বড় ট্রাক পণ্য নিয়ে ফেরি পারাপার হতে গেলে বাড়তি টাকা গুণতে হয়। ট্রাক চালকরা বলছেন, আরিচা ঘাটের চাইতে কাজির হাটে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি।
পাবনার ট্রাকচালক রুহুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে ট্রাকের চালক হিসেবে নিয়োজিত। গত দু’দিন কাজিরহাটে আটকে ছিলেন। দু‘দিন পর শুক্রবার সকালে আরিচা ঘাটে ফিরেছেন। তার ট্রাক এবং মালামালের ওজন ২০ টনের বেশি। ফেরি ভাড়াসহ সব মিলিয়ে ২০৪০ টাকার একটি রশিদ তাকে দেওয়া হয় কাজিরহাট টার্মিনাল থেকে। ট্রাকে ওভারলোড থাকার অজুহাতে টিকিট কাউন্টার থেকে ২৬০০ টাকা নিয়েছে। অথচ বাড়তি টাকার রশিদ ঘাট কর্তৃপক্ষ দেয়নি।
আজিজুল ইসলাম নামে লালমনিরহাটের আরেক ট্রাকচালক জানান, আরিচা কাজিরহাট নৌ রুটে ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিমাসে কমপক্ষে চার-পাঁচবার যাতায়াত করে থাকি। কাজিরহাট থেকে ফেরি পারাপারে ২৬০০ টাকার একটি রশিদ হাতে ধরিয়ে দিয়ে ৩০০০ টাকা নিয়েছে সেখানকার কাউন্টারের লোকজন। বাড়তি টাকা না দিলে ঘাটে দুই তিন দিন বসিয়ে রাখে। তবে আরিচা ঘাটে বাড়তি টাকা কম লাগে।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা ঘাটের টার্মিনাল অ্যাসিস্টেন্ট আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে রশিদে যে টাকা লেখা হয় সেই টাকায় আমরা ট্রাক চালকদের কাছ থেকে নিয়ে থাকি। যদি নির্ধারিত ওজনের চাইতে বেশি ওজনের ট্রাক ফেরি পারাপার হয় সেক্ষেত্রে ওজন নির্ধারণের স্কেল না থাকায় কিছু টাকা বেশি নেওয়া হয়। তবে সে টাকাগুলো সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।’ এসময় কাজিরহাটে বুকিং কাউন্টার থেকে ট্রাক চালকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা ঘাট ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. আবু আব্দুল্লাহ রনি বলেন, ‘দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পুনরায় ফেরি সার্ভিস চালু হয়। আরিচা ঘাট থেকে কাজিরহাটের দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এই লং নৌ পথে যানবাহন পারাপারে বেশি সময় লাগার কারণেই মূলত যানবাহনগুলো যমুনা সেতু ব্যবহার করে টাঙ্গাইল হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে। কারণ যমুনা সেতুর ওদিকে এখন আর যানজট পড়ে না। যার কারণে এই নৌপথে যানবাহনের মধ্যে শুধুমাত্র পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার হচ্ছে। তাছাড়া যাত্রীবাহী বাস এই নৌরুটে আসছে না। মাসে দু একটা যাত্রীবাহী বাস পাওয়াও দুষ্কর। রিজার্ভ কিংবা পিকনিকের গাড়িগুলো মাসে দু’একটি পাওয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে প্রায় একশ ট্রাক ফেরি পারাপার হয়ে থাকে। তাছাড়া এই ঘাট থেকে ট্রাক চালকদের কাছ থেকে কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া হয় না। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো নির্ধারিত ওজনের বাইরে মালামাল বহন করলে সরকারি রুলস অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তার রশিদ দেওয়া হয়। ট্রাক এবং মালামালের ওজন নির্ধারণের জন্য স্কেল থাকা জরুরি। স্কেল না থাকার কারণে আনুমানিক হারে বাড়তি ওজনের ট্রাক থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়। প্রতিদিনই সেই টাকা সরকারের কোষাগারে দেওয়া হচ্ছে। শুক্রবারও সারাদিন বিভিন্ন ট্রাকে অতিরিক্ত ৪৯১ টন ওভারলোড নেওয়ায় সরকার ৭৮ হাজার টাকার মতো রাজস্ব পেয়েছে।’
আরিচা ঘাটসংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন জানান, প্রায় দুই যুগ বন্ধ থাকার পর আরিচা ও পাবনার কাজীরহাট নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরু হয় ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মাসে। ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে এলাকাবাসী মনে করেছিলেন, আরিচা নৌবন্দর প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে। এতে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপও কমে যাবে। কিন্তু গত তিন বছরেও এমন দৃশ্য কারও চোখেই পড়েনি।
জনশ্রুতি রয়েছে, ভারত-পাকিস্তান বিভাগের আগে থেকেই যমুনা নদীর পাড়ে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচা ঘাট ছিল দেশের একটি বড় নৌ বন্দর। কলকাতা-আসাম রুটের জাহাজ স্টিমার এই ঘাটেই ভিড়তো। এখানে ছিল বড় বড় পাটের গুদাম। এই ঘাটকে ঘিরে আরিচায় গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র। পাকিস্তান আমলে এই ঘাটের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। কার্যত ১৯৬৪ সালে ঢাকা-আরিচা সড়ক চালু হওয়ার পর আরিচা থেকে যমুনা পাড় হয়ে নগরবাড়ি এবং আরিচা থেকে যমুনা-পদ্মা পাড় হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের সঙ্গে চালু করা হয় ফেরি সার্ভিস। সেই সঙ্গে আরিচা-নগরবাড়ি হয়ে ওঠে উত্তরবঙ্গ এবং আরিচা-গোয়ালন্দ হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের সড়ক যোগাযোগের অন্যতম প্রধান প্রবেশ পথ।
১৯৬৩ সালে ৩১ মার্চ কর্ণফুলি নামে একটি ফেরি সার্ভিস দিয়েই এই নৌরুটের যাত্রা শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়া পর দ্রুত বাড়তে থাকে আরিচা ঘাটের গুরুত্ব। একপর্যায়ে আরিচা ঘাটকে নৌবন্দরের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার যানবাহন পারাপার হতো। যাতায়াত ছিল গড়ে ৫০ হাজার মানুষের। তবে ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাটের গুরুত্ব কমে যায়। তার ওপর আরিচা ঘাটের কাছে যমুনা নদীতে নাব্যতা কমে যায়। এরপর সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আরিচা ফেরি ঘাট নিয়ে যাওয়া হয় পাটুরিয়াতে। সেই সঙ্গে মৃত্যু হয় এক সময়কার প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর আরিচা ঘাটের।
তবে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে রাজধানী যোগাযোগের পথ সহজ করার লক্ষ্যে পুনরায় ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আরিচা-কাজিরহাট নৌরুট ফের চালু করা হয়।
সারাবাংলা/এমও