জোয়ারভাটায় ফেরি চলাচলে বিপত্তি, সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই চলছেই
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:২১
রাঙ্গামাটি: পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি থেকে সরাসরি বান্দরবানে যাতায়াতের জন্য পাড়ি দিতে হয় কর্ণফুলী নদী। খরস্রোতা কর্ণফুলীর চন্দ্রঘোনা-রাইখালী অংশের মধ্যে ছোট ও ভারী যানবাহন নিয়ে পারাপারের একমাত্র উপায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের ফেরি। সাম্প্রতিককালে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমে নাব্য সংকট দেখা দেওয়ায় জোয়ারভাটায় নদীর তলদেশে আটকে যায় ফেরি। ফলে ভাটার সময়ে বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে হয় সওজকে।
স্থানীয়রা বলছেন, কর্ণফুলী নদীর চন্দ্রঘোনা অংশের দুই পারের দূরত্ব ৪৩০ মিটার। এই অংশে একটি স্থায়ী সেতু দুই পারের দূরত্বকে ঘুচিয়ে আনতে সক্ষম। দীর্ঘ দিন ধরেই তারা এই সেতুর দাবি জানিয়ে আসছেন। সওজ বলছে, তারা এই অংশের জন্য ৫৫০ মিটার একটি সেতুর প্রস্তাব দিয়েছে। সেতু বিভাগের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং (বিএমডব্লিউ) এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। এই কাজ চলতি বছর শেষ হতে যাচ্ছে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন বিএমডব্লিউর প্রধান প্রকৌশলী।
রাঙ্গামাটি থেকে সড়ক পথে বান্দরবানে যাতায়াতের প্রধান সড়ক এই একটিই, যেখানে ফেরি দিয়ে পারি দিতে হয় কর্ণফুলী নদী। খাগড়াছড়ি জেলা থেকে রাঙ্গামাটি হয়ে বান্দরবানে যেতেও একই পথ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিকল্প সড়ক হিসেবে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি বাসিন্দারা বান্দরবানে যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহর ঘুরে। কর্ণফুলী নদীতে পাকা সেতু নির্মাণ করা গেলে এই পথে যাতায়াত ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় ও সহজ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। নদীতে সেতু নির্মাণের ফলে স্থানীয় বিভিন্ন শিল্পেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন তারা।
কর্ণফুলী নদীর এই অংশের এক পারে রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন, সঙ্গে লাগোয়া চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লিচুবাগান বাজার। অন্য পারে কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়ন এবং রাইখালী হয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ও বান্দরবানে যেতে হয়। নদীতে সেতু হলে তাই রাঙ্গামাটি ছাড়াও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দারাও এর সুফল পাবেন। সেতু নির্মাণের জন্য বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতা ও সড়ক বিভাগ আশ্বস্ত করলেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এদিকে নদীতে জোয়ার-ভাটার কারণে সড়ক বিভাগের ‘লক্কর-ঝক্কর’ ফেরিটিও মাঝেমধ্যে বন্ধ রাখতে হয়। এ সময়ে নদী পারাপার নিয়ে বিপত্তি ও দুর্ভোগে পড়েন দুই পারের মানুষ, অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় যানবাহনকে। শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকটে অনিয়মিত ফেরি চলাচল আর বর্ষা মৌসুমে ফেরিতে ওঠানামার পথে পানি রীতিমতো দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে।
সেতু বিভাগের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং (বিএমডব্লিউ) সূত্র জানিয়েছে, নদীতে সেতু নির্মাণ করলে বিভিন্ন কারণে নদীর গতিপথ ও পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। কর্ণফুলী নদীর পানিপ্রবাহ ও গতিপথ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটি বিবেচনায় নিয়েই বিএমডব্লিউ চন্দ্রঘোনা সেতু নির্মাণের জন্য বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। ভৌগলিকভাবে সেতুটির অবস্থান পর্যটন জেলায় হওয়ায় সেতুর নকশায় নান্দনিকতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তবে চার লেনের সেতুটির দৈর্ঘ্য এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এটি বড় প্রকল্প হওয়ার কারণে পৃথকভাবে প্রকল্প নিয়ে তারপর সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে।
পরিবহন মালিকদের তথ্য বলছে, প্রতিদিন রাঙ্গামাটি-বান্দরবান রুটে বান্দরবান পর্যন্ত চারটি ও রাজস্থলী উপজেলা পর্যন্ত ১০টি যাত্রীবাহী বাস যাতায়াত করে থাকে। রাঙ্গামাটি-বান্দরবান রুটের সব বাসসহ হালকা ও ভারী যানবাহনকে এই ফেরি দিয়েই কর্ণফুলী পার হতে হয়। তবে সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, মালবাহী ট্রাকসহ অন্যান্য যান চলাচলের কোনো পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়দের অনুমান, প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচ শ ছোট-বড় যানবাহন ফেরি দিয়ে পারাপার হয়।
বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কে চলাচলকারী ভারী যানবাহনের চালকরা জানান, কর্ণফুলী নদীতে চন্দ্রঘোনা ফেরি পারাপারে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পর্যটক ও যাত্রীবাহী বাস, মালামাল পরিবহনকারী ট্রাকসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহন পারাপারে ফেরিটিই সম্বল। কখনো ফেরি বাধার তার ছিড়ে (লোহার দড়ি), কখনো নদীর তলদেশে বালিতে ফেরি আটকে পারাপার বন্ধু হয়ে যাচ্ছে। সেতু নির্মাণ ছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণ অসম্ভব।
কর্ণফুলী নদীতে সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) রাঙ্গামাটি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সওজের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। যেহেতু কর্ণফুলী নদীতে জোয়ারভাটা ও স্রোত আছে, তাই সেখানে সেতু নির্মাণ করতে গেলে কিছু কারিগরি বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। সেতু নির্মাণের পদ্ধতি ও প্রযুক্তিসহ সেতুর নকশা ও যাবতীয় বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করছে বিএমডব্লিউ। তবে কর্ণফুলী সেতু নির্মাণ করা হলেও সেটি হয়তো আলাদাভাবে প্রকল্প নিয়ে করা হবে, রাঙ্গামাটি বিভাগের অধীনে হবে না।’
কর্ণফুলী নদীতে বাধাগ্রস্ত না করার দিকেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শিশির কান্তি রাউৎ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘চন্দ্রঘোনা সেতুর কাজটি গুরুত্বপূর্ণ ও বড় প্রকল্প। তাই বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। এই নদীতে স্রোত ও জোয়ারভাটা আছে। অনেক সময় সেতু নির্মাণ করা হলে নদীর গতিপথ পালটে যায়। নদীর গতিপথ ও পানিপ্রবাহ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে দীর্ঘ স্প্যান করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
শিগগিরিই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘পার্বত্য জেলাগুলো পর্যটন এলাকা হওয়ায় একে একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু হিসেবে তৈরি করা হবে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নকশা করা হচ্ছে। নদীর গতিপথ সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন রাখতে দীর্ঘ স্প্যানের চার লেনের সেতু করা হবে। অন্যান্য বড় প্রকল্পের মতো চন্দ্রঘোনা সেতুর জন্যও আলাদা প্রকল্প করা হবে। লেন তবে আমরা আশাকরছি শীঘ্রই বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হবে। আশা করছি শিগগিরই বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হবে।’
সারাবাংলা/টিআর
কর্ণফুলী নদী চন্দ্রঘোনা চন্দ্রঘোনা সেতু বিএমডব্লিউ ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং রাইখালী রাঙ্গামাটি সওজ সেতু বিভাগ