মধ্য ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেলে বইমেলা জুড়ে টুকরো টুকরো গল্প
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২৩:৫৯
ফাল্গুনের ১৪তম দিন। ঋতুরাজ বসন্তের পড়ন্ত বিকেল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে মানুষের কোলাহল। কারও হাতে বই, কারও হাত খালি, আবার কারও হাত প্রিয়জনের হাতের সঙ্গে আঁটা। কেউবা বসে আছেন জলাধারের পাশে, কেউ সেলফি তুলতে ব্যস্ত। কেউবা মুঠোফোনে ছবি তুলে স্মৃতিটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কেউ আবার ঘোরাঘুরি শেষে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
অমর একুশে বইমেলার ২৭তম দিন এমন চিত্র ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ জুড়ে। শীতের বিদায় শেষে মধ্য ফল্গুনে চারিদিকে যখন গরমের মৃদু পদধ্বনি, মানুষের মনে যখন উদাস ভাবের সঞ্চার হচ্ছে একটু একটু করে, ঠিক তখন বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব অমর একুশে বইমেলায়ও বাজতে শুরু করেছে বিদায়ের সুর। সে কারণেই হয়তো ব্যস্ততম কর্মদিবসেও বইমেলা হয়ে উঠেছে মানুষের পদচারণায় মুখোর।
শুধু বই কেনা আর বইয়ের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য যে মেলা নয়, সেটা বহুকাল ধরেই প্রতিষ্ঠিত সত্য। সাহিত্য আড্ডা, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এবং পাঠক-লেখক-প্রকাশকদের মেলবন্ধনের এক অন্যতম সুযোগ এনে দেয় অমর একুশে বইমেলা।
মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সাড়ে ৪টায় বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে অস্থায়ী মসজিদসংলগ্ন খোলা জায়গায় দেখা গেল চমৎকার এক দৃশ্য। বাসা থেকে রীতিমতো কিং সাইজের দুইটা বেডিশিট, ব্যাগ ভর্তি খাবার, কিচেন টিস্যু এবং কোথা থেকে যোগাড় করা কলাপাতা নিয়ে হাজির হয়েছেন একদল লোক। প্রগতিশীল সাহিত্য সংঘের এই লোকগুলোর কাছে বইমেলা এক অন্যরকম আনন্দের উপলক্ষ্য। এরা শুধু বইকেনা এবং বইপড়ার মধ্যে জীবনকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। জীবনের অপার আন্দন খুঁজে নিয়েছেন বই ও মেলার মধ্যে।
কথা হয় প্রগতিশীল সাহিত্যে সংঘের অন্যতম সদস্য মেহেদী হাসান শোয়েবের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দেখতে দেখতে বইমেলার আয়ু শেষ হয়ে এল। তাই আমরা সবাই এখানে একত্রিত হয়েছি। গল্প-আডার মধ্য দিয়ে দিনটি ভালো মতো কাটাতে চাই।’
‘আমাদের এখানে কিন্তু প্রত্যেকেই লেখক। ওই যে যাকে দেখছেন, উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। সারাদেশ ঘুরে ছয়শ’ মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। প্রতি একশ’ মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা করে বই লিখেছেন। প্রথম তিন খণ্ড বের হয়েছে। পরেরগুলো ধারাবাহিকভাবে বের হবে’— বলেন মেহেদী হাসান শোয়েব।
শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও এরকম অসংখ্য টুকরো টুকরো গল্পের বিছানা পাতা ছিল বইমেলার ২৭তম দিনে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভবন এবং একাডেমির পুকুর পাড় ঘিরে অসংখ্য মানুষ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। ফাগুনের উদাস বিকেল ভাগাভাগি করে নিয়েছেন প্রিয়জনের সঙ্গে।
একাডেমির পুকুর পাড়ে কথা হয় তরুণ কবি চামেলী বসুর সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি জানান, শিল্প-সাহিত্যের ছোট কাগজ শালুকের সম্মেলন হতে যাচ্ছে শিগগিরই। এ বিষয় নিয়ে শালুক সংশ্লিষ্টরা সাংগঠনিক আলাপ এবং আড্ডার জন্য একত্রিত হয়েছিলেন। আয়োজনটা যেহেতু বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ হলে, সেহেতু ভেন্যু পরিদর্শন এবং প্রয়োজনী আলাপ সারতেই তাদের এখানে আসা।
তার মানে এই নয়, শুধু আড্ডা দেওয়ার জন্যই সবাই বইমেলায় এসেছেন। মেলার শেষ দিকে এসে বই কেনার লোকও আনুপাতিক হারে বেড়েছে। মেলা ঘুরে দেখা গেছে, দর্শনার্থীদের অনেকের হাতেই বইয়ের ব্যাগ। বইমেলার বিদায় বেলায় পছন্দের বই কিনে ঘরে ফিরেছেন অনেকেই।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথা হয় কবি এম উমর ফারুকের সঙ্গে। বেশ কয়েকটা বই কিনেছেন তিনি। সারাবাংলাকে উমর ফারুক বলেন, ‘আমরা যারা লেখা-লেখির সঙ্গে যুক্ত, তাদের জন্য বই কেনাটা অত্যাবশ্যকীয় কাজ। না পড়লে যে কিছু লেখা যায় না, এটা নতুন করে বলার নেই। বইমেলা যেহেতু শেষের দিকে তাই আজ কিছু বই কিনে ফেললাম। আরও কিছু বই কিনব।’
কথা হয় পুথিনিলয় প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী আইয়ুব সাকিলের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখন যারা মেলায় আসছেন, তাদের মধ্যে বই কেনার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে দশ জন এলে একজন কিনত। এখন হয়তো দশ জনের মধ্যে দুই জন কিনছেন।’
এদিকে, আজ বাংলা একাডেমি থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে বইমেলার ২৭তম দিনে নতুন বই এসেছে ৯৫টি। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ : সেলিম আল দীন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লুৎফর রহমান। আলোচনায় অংশ নেন রশীদ হারুন এবং জাহিদ রিপন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ।
প্রাবন্ধিক বলেন, ‘বাংলা নাটকের ইতিহাসে সেলিম আল দীনের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অস্থির পরিস্থিতিতে প্রকৃত বাস্তবকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপন করাকেই তার কর্তব্য বলে মনে করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চিত্র তার নাটকে মূর্তরূপ লাভ করেছে। নাটক রচনাকালে তার চেতনার ভূগোল তৈরি হয়েছে সমগ্র প্রকৃতি, মানুষ, জনপদ, জীবন এবং গ্রামীণ ও নাগরিক সমাজের বিদ্যমান দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে।’
আলোচকরা বলেন, সচেতন নাট্যকার হিসেবে সেলিম আল দীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তার নাটকের ভেতর সমকালীন বাস্তবতার চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। সমাজ-চেতনা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেলিম আল দীনের নাটকেও বিবর্তন এসেছে। তিনি এ অঞ্চলের শিল্পরীতি ও শিল্পদর্শনকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত করেছেন এবং বাঙালির নাট্য-সংস্কৃতি ও নাট্যযাত্রার পথকে সুগম করার জন্যে আজীবন কাজ করে গেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘সেলিম আল দীন রাজনীতি ও মানুষকে একীভূত করে তার নাট্যভূমি নির্মাণ করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের পক্ষাবলম্বন না করে শিল্পীর নির্মোহ অবগাহন থেকে তিনি নাট্যচর্চা করেছেন।’
বইমেলায় হুমায়ুন আজাদকে স্মরণ
বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার বার্ষিকীতে বিকেল ৫টায় হুমায়ুন আজাদ দিবস পালন উপলক্ষ্যে লেখক-পাঠক ফোরামের উদ্যোগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার তথ্যকেন্দ্রের সামনে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। প্রকাশক ওসমান গনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বক্তৃতা করেন কবি মোহন রায়হান, কবি আসলাম সানী, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, হুমায়ুন আজাদের হত্যাচেষ্টার বিচার অবিলম্বে বাস্তবায়ন এবং তার আদর্শে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমেই তাকে যথাযোগ্যভাবে স্মরণ করা হবে।
আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রেজানুর রহমান, শিশুসাহিত্যিক মানজুর মুহাম্মদ, কবি রণক মুহম্মদ রফিক এবং গবেষক অমল গাইন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি রওশন ঝুনু, হাসনাইন সাজ্জাদী, মাহী ফ্লোরা এবং মোস্তাফিজুর রহমান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী পারভেজ চৌধুরী, কুমার লাভলু, নাজমুল আহসান এবং মুজাহিদুল ইসলাম।
এ ছাড়া, ছিল সালাউদ্দিন বাদলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী’, মোশাররফ হোসেনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দৃষ্টি’, মোস্তাফিজুর রহমানের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভাওয়াইয়া অঙ্গন’ এবং মৈত্রী সরকারের পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন ‘স্বপ্নবিকাশ কলা কেন্দ্র’র পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী লিলি ইসলাম, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, চঞ্চল খান, অণিমা রায়, কামাল আহমেদ, আশরাফ মাহমুদ, সালমা চৌধুরী, মীরা মন্ডল, ঝুমা খন্দকার, শেলী চন্দ, ইরাবতী মন্ডল এবং সেলিনা আলম।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম মজুমদার (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কি-বোর্ড), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), নাজমুল আলম খান (মন্দিরা) এবং রিচার্ড (গিটার)।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম