জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অনীহা রোহিঙ্গাদের!
২৪ মে ২০১৮ ২১:২৪
।। জান্নাতুল ফেরদৌসী ও জাকিয়া আহমেদ ।।
কক্সবাজার থেকে: উখিয়া কুতুপালং হিন্দুপাড়া শরণার্থী শিবিরের একেবারেই পেছনের দিকের একটি ঘরে স্মৃতি রুদ্র-যদুরাম রুদ্র দম্পতির বসবাস। বুধবার (২৩ মে) সকালে তাদের অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে গিয়ে দেখা গেল, ১০ দিনের নবজাতককে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন স্মৃতি রুদ্র, পাশেই চার বছরে সন্তান রনি আর দুই বছরের স্মরণীকাকে ভাত খাওয়াচ্ছেন যদুরাম রুদ্র।
গত বছরের আগস্টের এক রাতে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন যদুরাম রুদ্র। এখানে এসে তাদের ঠাঁই হয় হিন্দুপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে। দিন দশেক আগে এখানকার এই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরেই প্রতিবেশি বৃদ্ধার হাতে জন্ম নেয় তাদের তৃতীয় সন্তান। প্রসূতিদের জন্য পাশেই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থাকলেও সেখানে যাননি তারা, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে কোনো টিকাও নেননি স্মৃতি। নবজাতককেও দেওয়া হয়নি টিকা। যদুরাম বলেন, স্ত্রীর লজ্জার কারণে টিকা বা কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া হয়নি।
জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেন কিনা— জানতে চাইলে লজ্জা পান স্বামী-স্ত্রী দু’জনই। পরে স্মৃতি জানান, কখনোই তারা এমন কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ বিষয়ে কোনো ধারণাও তাদের নেই।
ঠিক দুই ঘর পরেই ববিতা রুদ্রের ঘর। কথা হয় তার সঙ্গেও। তিন সন্তানের জননী ৩০ বছরের ববিতা এখন ফের আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শুধু তাই নয়, আরো সন্তান নিতে আগ্রহী এ ববিতা ও তার স্বামী। আর জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো ধারণা বা আগ্রহ নেই তাদেরও।
কেবল এই দুই দম্পতি নয়, হিন্দু পাড়ার রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই সন্তান সংখ্যা কমপক্ষে তিন। তাদেরও অধিকাংশেরই বয়স পাঁচ বছরের কম। এরপরও তারা আরো সন্তান চান। আর এসব দম্পতির স্বামী বা স্ত্রী— কেউই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন না এবং এ ধরনের কোনো পদ্ধতি নিতে তাদের রয়েছে প্রবল অনীহা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শতকরা ৩৯ ভাগ পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচ জন। এর বাইরে পাঁচ থেকে আট সদস্যের পরিবার আছে ২১ শতাংশ; আর আট জনের বেশি সদস্য রয়েছে শতকরা তিন ভাগ পরিবারে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মোট ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জনসংখ্যায় পুরুষের সংখ্যা ৫২ শতাংশ, নারী ৪৮ শতাংশ। মোট রোহিঙ্গার শতকরা ৫৫ ভাগই শিশু।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিনই জন্ম নিচ্ছে শিশু। গত আগস্টে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করার পর থেকেই তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সর্ম্পকে তাদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই সময় তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণও দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব তারা গ্রহণ করেননি। জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ জনগোষ্ঠীর কোনো সচেতনতা নেই, নেই কোনো আগ্রহও।
বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে এবং মানবিক সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলোর সহায়তায় প্রণীত জেআরপি’র (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান বা যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা) তথ্য অনুযায়ী, ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৫২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৪০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও ১০টি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। অথচ এসব কেন্দ্রে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়া প্রসূতির সংখ্যা খুবই কম।
গত ১৬ মে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানায়, রোহিঙ্গ ক্যাম্পে প্রতিদিন ৬০টি করে শিশুর জন্ম হচ্ছে। সে হিসাবে ক্যাম্পগুলোতে এখন পর্যন্ত ১৬ হাজারের বেশি শিশু জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেদার বলছেন, অনেক রোহিঙ্গা নারীই ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন। তবে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা খুঁজে পাওয়াটা অসম্ভব।
রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একেবারেই কার্যকর নয় জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম সারাবাংলা’কে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ও অন্ধকারে ছিল। ফলে এটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও তাদের সচেতন করার জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে।’ এ পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের মনোভাব সহসাই বদলাবে— এমন ভাবনাকে অমূলক বলে মনে করছেন আবুল কালাম।
একই কথা বলেন ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) ন্যাশনাল পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার সালমা রহমান। পরিবার ছোট রাখার বিষয়ে সচেতনতা বা সংস্কৃতি কোনোটাই রোহিঙ্গাদের ছিল না মন্তব্য করে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে এই জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। এমনকি, ওষুধ বা টিকার মতো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাও তারা পায়নি।’ জন্ম নিয়ন্ত্রণের ধর্মীয় গোঁড়ামি কাজ করেছে বলেও জানান তিনি।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর সারাবাংলা’কে বলেন, ক্যাম্পগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি কন্ট্রাসেপটিভ দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। পাঁচ বছর মেয়াদি ইমপ্ল্যান্ট তাদের জন্য সাজেস্ট করা হচ্ছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের এসব পদ্ধতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য কতটুকু কার্যকর হতে পারে— জানতে চাইলে এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘তাদের বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু কাজটা খুব কঠিন।’ রাখাইনে ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং’ বলে কিছু ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘নভেম্বর থেকেই সরকার এ বিষয়ে কাজ করছে। এখন জাতিসংঘের ইউএনএফপিএ-ও কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এতে আদৌ কোনো কাজ হচ্ছে কিনা, সেটা বলা মুশকিল।’
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ/টিআর