Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিলিন্ডার রাখায় ব্যবহার অনুপযোগী ছিল ভবনের সরু সিঁড়ি

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১ মার্চ ২০২৪ ১৯:৪৬

ঢাকা: রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রীন কফি কটেজ ভবনে লাগা আগুনে ৪৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য হাসপাতালে যু্দ্ধ করছেন  আরও ১০ জন। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সর্বোচ্চ চেষ্টায় প্রায় দুই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে নিভে যায় ৪৬ জনের জীবন প্রদীপ।

রাজধানী ঢাকা শহরে যতবার বড় কোনো আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ততবারই উঠে আসে জরুরি নির্গমন পথ নেই। সিঁড়ি ঘরের দরজা তালাবদ্ধ থাকা কিংবা ভবনে অতিরিক্ত সিঁড়ি নেই। প্রতিবারই তদন্ত হয়, প্রতিবেদন জমা হয় অথচ পুড়ে যাওয়া ভবন মেরামত করা হলেও থেকে যায় আগের মতোই।

বিজ্ঞাপন

ভবনে কাজ করেন এমন বেশ কয়েকজন প্রাণে বেঁচে ফিরে জানান, ৭ তলা ভবনটিতে উঠানামায় একটি সরু সিঁড়ি থাকলেও তা ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। সিঁড়িটি ছিল ব্যবহার অনুপযোগী। পুরো ভবনের জন্য ছিল কেবলমাত্র ছোট লিফট। এই ছোট লিফট দিয়েই লোকজন উঠানামা করতেন।

বৃহস্পতিবার আগুন লাগার ফলে ভবনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একমাত্র ছোট লিফটিও বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকার ফ্লোরগুলোতে নারী পুরুষ ও শিশুরা ছোটাছুটি ও চিৎকার করতে থাকেন।

ব্যবহার অনুপযোগী সিঁড়িতে থাকা গাদা গাদা সিলিন্ডার সরিয়ে কেউ কেউ ভবনটির ছাদে উঠতে পারলেও বেশিরভাগই আটকা পড়েন ফ্লোরগুলোতে। কেউ সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়েও নামতে পারেননি। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন তারা।

ওই ভবনে পাঠাওয়ের ফুড ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করেন ইমরান হোসেন। তিনি জানান, ভবনের লিফটের ৭ এ ছিল নামাজের জায়গা ও এম্বসিয়া রেস্টুরেন্ট। লিফটের ৬ তে ছিল ফোকো ও হাক্কাডাক্কা নামে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। লিফটের ৫ এ ছিল স্টিুটওভেন, জেএসটি রেস্টুরেন্ট। লিফটের চার তলায় পিজ্জা ইন। লিফটের ৩ এ খানাস নামে ফাস্টফুডের দোকান। খানাসে পার্টি হতো। লিফটের ২ এ কাপড়ের দোকান। লিফটের ১ এ কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট। নিচতলায় ছিল মেজবানি খানা, চায়ের চুমুক নামে মিনি বার্গার ও চায়ের দোকান, শেফলি রেস্টুরেন্ট ও দুটি মোবাইলের দোকানসহ মোট ৮টি দোকান।

বিজ্ঞাপন

আগুন লাগার সময় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইমরান হোসেন বলেন, ‘নিচতলার চায়ের চুমুক নামে রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পুলিশের একজন সার্জেন্টসহ আশেপাশের লোকজন আগুনটি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। এ সময় পাশে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। তখন আগুন ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস আসে।

ইমরান বলেন, ‘ আগুন লাগার পরপরই ওপরের রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকা লোকজনকে নেমে আসার জন্য বলা হয়েছিল। অনেক অনুরোধ করা হয়। সবাই চেয়ে দেখছিল। হয়ত ভাবছিলেন, আগুন নিচে লেগেছে, তাতে ভবনের ওপর তলাগুলোতে লোকজনের কী ক্ষতি হবে? আগুন ছড়িয়ে পড়লে এর কিছুক্ষণ পর আর কেউ নামতে পারেনি। কেউ কেউ লাফ দিয়েছেন। কিন্তু শুরুতেই নামতে চাইলেও সিড়ির এক সাইড দিয়ে নামতে পারতেন অনেকেই।’

চারতলায় (লিফট-৪) খানাস নামে ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন জুবায়ের হাসান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। তিনি বলেন, ‘নিচ থেকে শুনতে পারি আগুন লেগেছে। এরপর সব ফেলে নিচে নামতে গিয়ে বাধা পাই কারণ ওই সময় ভবনের সবাই আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করছিল। অনেক কষ্টে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠি। ছাদে অনেক লোক চিৎকার করছিলেন। কোনো সাড়া না পেয়ে একজন ছাদ থেকে লাফ দেন। তখন আমিও লাফ দেই। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।’

ভবনের নিচ তলায় মেজবানি খানা নামে রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পর সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে যাই। দেখি নিচে ভয়াবহ অবস্থা।ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। রে পঞ্চম তলায় গিয়ে কিচেনের গ্রিল দিয়ে নামতে যাই। কিন্তু আগুনের তাপ অনেক বেশি ছিল। এরপরও লাফ দেই। আর কিছু মনে নেই।’

কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ভবনটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ জরুরি মুহূর্তে নামার জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না । ফায়ার সার্ভিসসহ অনেকে ব্যবস্থা নিতে এলেও কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই চলে যেতেন তারা। ফলে দিনের পর দিন থেকে গেছে একই অবস্থায়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেইলি রোডের এই ভবনটি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের মালিকানাধীন। ভবনটি নির্মাণের পর বেশিরভাগ ফ্লোর বিক্রি করে দেয় কোম্পানিটি। ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেওয়ার জন্য যেসব শর্তাবলি থাকার কথা তার কোনোটিই উপস্থিত ছিল না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট তদারককারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এরমধ্যে ফায়ার সার্ভিস থেকে তিন দফায় নোটিশ দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। বরং একমাত্র সিঁড়িটিতেও গ্যাস সিলিন্ডার স্তূপ করে ভবনটিকে আরও ঝুঁকিতে রাখা হয়েছিল। যে খামখেয়ালির কারণে আজ ৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিক ব্রিফিংয়ে বলেন, বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই ভবনে একাধিক রেস্টুরেন্ট ছিল, ছিল সিলিন্ডারও। এ জন্য ভবনটি ছিল অগ্নিচুল্লির মতো। যার জন্য দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লাগতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।

সারাবাংলা/ইউজে/একে

অগ্নিকাণ্ড আগুন কাচ্চি ভাই বেইলি রোড ভবন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর