পাত্তাই পাচ্ছে না সরকারি দাম, ২ মিলে ‘লোক দেখানো’ অভিযান
২ মার্চ ২০২৪ ১৯:৫৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: লিটারপ্রতি দশ টাকা কমিয়ে সরকার নির্ধারিত খুচরা দরে চট্টগ্রামে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে না। এমনকি সরকার নির্ধারিত দামে কারখানাগুলো এখনও সয়াবিন তেল বাজারে সরবরাহ শুরু করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে রেকর্ড আমদানির পরও খুচরা বাজারে এখনও ভোজ্যতেলের দাম লাগামহীন।
এ অবস্থায় শনিবার (২ মার্চ) সকালে চট্টগ্রামে এস আলম ও সিটি গ্রুপের দুই ভোজ্যতেল কারখানায় মজুত ও বিক্রয় পরিস্থিতি পরিদর্শনে যান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের একটি টিম। দুই কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা সরকার নির্ধারিত দরে তেল সরবরাহ শুরু করেছে। বাস্তবে কাদের মাধ্যমে, কখন থেকে তারা সরবরাহ শুরু করেছে এ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকে দিতে পারেনি।
সরকারের নির্ধারিত সময়ের দুইদিনের মধ্যে বাজারে ঘোষিত দরে তেল সরবরাহ নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেকটা মিলগুলোর কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়েই শেষ করেছে ‘লোক দেখানো’ অভিযান।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা বিষয়ক টাস্কফোর্সের সভায় সয়াবিন তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৩ টাকায় এবং প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৪৯ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম পড়বে ৮০০ টাকা।
১ মার্চ থেকে সয়াবিন তেলের নতুন এই দর কার্যকর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যা পরে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু শনিবার (২ মার্চ) নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, লিটারপ্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৭৫ টাকার মধ্যে। তবে এস আলম ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের দাম শনিবার সন্ধ্যা থেকে বাজারে কিছুটা পড়তির দিকে দেখা গেছে।
নগরীর কাজীর দেউড়ি সিডিএ এভিনিউ মার্কেটে সাদিয়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সপ অ্যান্ড সেভ সুপারস্টোর, হক ভাণ্ডার স্টোর এবং ফয়েজ স্টোরে সয়াবিন তেলের দাম যাচাই করা হয়। দেখা গেছে, এস আলম সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৫ টাকায় বিক্রি হলেও সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ডের দাম ১৭০ টাকা। এছাড়া বসুন্ধরার সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৭০ টাকা, রূপচাঁদা ১৭৫ টাকা, পুষ্টি ১৭০ টাকা, ফ্রেশ ১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকার নিচে কোনো সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে না। আসকার দিঘীর পাড় এলাকার মুদি দোকানি রূপন কান্তি দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৬৩ টাকা দামে সয়াবিন তেলের বোতল আমরা এখনও পাইনি। পাইকারি বাজারেই ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমাদের দুই-চার টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
নতুন দর কার্যকর হওয়ার প্রথমদিনে শুক্রবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা নগরীর কয়েকটি খুচরা বাজারে গিয়ে তেলের দাম যাচাই করেন। কোনো দোকানেই নতুন দর কার্যকর হয়েছে, এমনটা তারা পাননি বলে জানা গেছে।
অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনিছুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা খুচরা বাজারে গিয়েছিলাম। সেখানে আগের দরে কেনা সয়াবিন তেল রয়ে গেছে। সেগুলো বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। আমরা তাদের সতর্ক করেছি। সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রির নির্দেশনা দিয়েছি। ব্যবসায়ীরা কথা দিয়েছেন, তারা আগের দরে কেনা সয়াবিন তেল ফেরত দিয়ে সরকার নির্ধারিত দরে তেল কিনে দোকানে তুলবেন এবং বিক্রি করবেন। আমরা এটি নিয়মিত মনিটরিং করব।’
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে শনিবার প্রতিমণ (৩৭ দশমিক ৫০ লিটার) খোলা সয়াবিন তেল ৫ হাজার ৫৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ হিসেবে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল পাইকারিতে ১৪৮ টাকা দাম পড়ছে। কিন্তু সরকার খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি খুচরাতেই নির্ধারণ করেছে ১৪৯ টাকা।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের দাবি, পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলে ক্রেতা নেই। এজন্য দাম বরং কমেছে। গত সপ্তাহে খোলা সয়াবিন তেল প্রতিমণ ৫৫৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এ সপ্তাহে সেটা মণপ্রতি ২৫ টাকা কমেছে।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী প্রবীর সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এস আলমের খোলা সয়াবিন তেল ৫ হাজার ৫৪০ টাকায় মণ আমরা বিক্রি করছি। মিলগেট থেকে আমাদের যে দামে সরবরাহ করা হয়েছে, আমরা ২০-৩০ টাকা বাড়তি ধরে তেল ছেড়ে দিচ্ছি। বাজারে কাস্টমার নেই। মার্কেট বরং স্থিতিশীল আছে।’
ভোগ্যপণ্যের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ী, রমজানে দেশে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিকটন ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে।
রোজায় ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে এসে আমদানি ও উৎপাদন-ব্যবসা পর্যায়ে শুল্কও কমিয়ে দেয় সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পরিশোধিত-অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে সয়াবিন তেলের শুল্ক প্রতি লিটারে ৫ থেকে ৬ টাকা কমে যায়।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রমজানকে সামনে রেখে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিকটন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত গত সাড়ে তিন মাসে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৬ দশমিক ৪২ মেট্রিকটন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়। শুল্কহার কমানোর পর আরও প্রায় ৬০ হাজার মেট্রিকটন ভোজ্যতেল এসেছে।
গত বছর একই সময়ে ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৩ দশমিক ৭৩ মেট্রিকটন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরও পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের দাম প্রতিনিয়ত উঠানামা করছে। পাইকারি বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম কিছুটা কমলেও খুচরায় এর প্রভাব পড়ছে না।
এমনকি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপগুলোর ভোজ্যতেল কারখানা থেকে সরবরাহ করা তেলের দাম নিয়ে প্রশ্ন আছে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের। তাদের অভিযোগ, ডলার সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে কোনো ঘোষণা ছাড়াই বছরের শুরুতে হঠাৎ লিটারে প্রায় ৪ টাকা দাম বাড়িয়ে দেয় দেশের বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ ও বাজারজাত করা প্রতিষ্ঠানগুলো। শুল্কহার কমানোর পরও সেটা আর পুনঃনির্ধারণ হয়নি।
এ অবস্থায় ভোজ্যতেলের মজুত ও সরবরাহ পরিস্থিতি দেখতে শনিবার সকালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জ্যারটেকে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল এবং পতেঙ্গায় সিটি গ্রুপের বিওটিটিবি কমপ্লেক্স কারখানায় যান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। তারা কারখানাগুলোর সক্ষমতা অনুযায়ী বর্তমানে উৎপাদনের পরিমাণ এবং বাজারজাতের তথ্য যাচাই করেন। এছাড়া ১ মার্চ থেকে কার্যকর হওয়া নতুন দামে তেল সরবরাহ হচ্ছে কি না তা-ও খতিয়ে দেখেন।
জানতে চাইলে অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনিছুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, প্রতি লিটার বোতল ১৬৩ টাকা। সেই ভোক্তামূল্য উল্লেখ করে তারা উৎপাদিত সয়াবিন তেল বোতলজাত করছে কি না সেটা আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা দেখেছি, তারা বরং সরকারের দরের চেয়ে আরও এক টাকা কমে অর্থাৎ ১৬২ টাকায় উৎপাদন করছে।’
অভিযানে যাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের মহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম এবং বিওটিটিবি কমপ্লেক্সের মহাব্যবস্থাপক দাবি করেন, তারা সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কম দামে সয়াবিন তেল বোতলজাত করে বাজারে সরবরাহ করছেন। আলাদা অভিযানে কর্মকর্তারা গত দু’দিনে কারখানাগুলো থেকে কোথায়, কী পরিমাণ বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করা হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য চান। কিন্তু তারা সেটা দেখাতে পারেননি।
আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের উৎপাদন এবং তারা কোথায়-কোথায় সরবরাহ করেছে সেটার তালিকা চেয়েছি। এরপর গত দুইদিনে কোথায় সরবরাহ করেছে সেটারও তালিকা চেয়েছি। আগামীকাল (রোববার) দুপুর ১টার মধ্যে তাদের এটা সাবমিট করতে বলেছি।’
খুচরা বাজারে গত দুইদিনেও সরকারি দর কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আশা করছি, কালকের (রোববার) মধ্যে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সয়াবিন তেল বিক্রি হবে।’
এদিকে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুও জানিয়েছেন, রোববার (৩ মার্চ) থেকে খুচরা বাজারে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সয়াবিন তেল বিক্রি হবে।
শনিবার (২ মার্চ) সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘দি অ্যাসোসিয়েশন অব গ্রাসরুট ওমেন এন্ট্রেপ্রেনার্স বাংলাদেশ (এজিডব্লিউইবি) আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নেয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রতিমন্ত্রী। এসময় তিনি বলেন, ‘মিল থেকে বাজার পর্যন্ত নতুন মূল্যের প্রভাব পৌঁছাতে একটু সময় লাগে। মিল মালিকরা নিজেরাই জানিয়েছেন ১ তারিখ থেকে নতুন মূল্য কার্যকর করার কথা। ইনশল্লাহ, রোববার থেকেই নতুন মূল্য অনুযায়ী ভোক্তারা ভোজ্যতেল কিনতে পারবেন।’
সারাবাংলা/আরডি/একে