ভবনে আগুন: ক্রেতাশূন্য বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ-শপিং মল
৫ মার্চ ২০২৪ ০০:১৭
ঢাকা: আন্তর্জাতিক রেস্তোরাঁ কেএফসি। সবসময় ক্রেতাদের ভিড়ে ঠাসা থাকতো। খাবার কিনে বসার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন ক্রেতারা। সেখানে গত দুই দিন ধরে ক্রেতা নেই। অন্য খাবার দোকানগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। সেইসঙ্গে শপিং মলগুলোতেও ক্রেতা আসছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় পুলিশের অভিযানের কারণে কিছু রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। বসতে দেওয়া হচ্ছে না ফুটপাথের ব্যবসায়ীদেরও। বেইলি রোডে ভবনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতারা। তারা দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়ার দাবি জানিয়ে বৈধ ব্যবসায়ীদের হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বেইলি রোডের ব্র্যান্ডশপ আর্টিসান। সেখানকার বিক্রি বলতে গেলে শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। ওই দোকানের কর্মী শেখ আশিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শো-রুম বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছিল ঠিক তখনি পাশের ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটে। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নিজেদের পণ্য রক্ষা করব, নাকি জীবন বাঁচাব। একরকম দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা জীবনে দেখিনি। দেখেছি মানুষ বাঁচার জন্য কি আকুতিই না করেছে। মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। ওই দুর্ঘটনার পর বেচা বিক্রি বলতে গেলে শূন্যে নেমে গেছে। গত তিন চার দিন ধরে ক্রেতা নেই।’
সুইচ বেকারির কর্মী ইলিয়াস খান সারাবাংলা বলেন, ‘সুইচ সবসময় ক্রেতায় পরিপূর্ণ থাকে। রাস্তার পাশে দোকান হওয়ার পরও ক্রেতা কমে গেছে। দুইদিন তো মানুষই ঢোকেনি সুইচে।’ এ ছাড়া, ক্রেতা কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন কে ক্রাফট্, সাদা কালো, গাঁওগেরাম, বাংলার মেলা, দেশাল, বিশ্ব রঙ শোরুমের কর্মীরা।
এদিকে, শপিং মল ক্যাপিটাল সিরাজুলেও ক্রেতা কম দেখা গেছে। ৭০% ডিসকাউন্ট দিয়েও ক্রেতা টানতে পারছেন ‘ভোগ বাই প্রিন্স’ ব্র্যান্ড। ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে কসমেটিকসের শোরুম ‘সাজগোজ’, ‘ওয়েস্টার্ন’সহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডে। শপিং মল বেইলি স্টারেও একই পরিস্থিতি।
অ্যাস্ট্রোরিয়েন কর্মীরা জানান, ‘আগুন লাগার পর থেকে ক্রেতা কম। সারাদিনে ক্রেতার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়লো, টেক্সটমার্ট, রাইজ, স্টার ডাস্ট, কোলকাতার ভাবির মতো দোকানগুলোতে অন্য দিন এই সময়ে প্রচুর ভিড় লেগে থাকতো। ভিড় থাকতো খাবারের দোকান বুমার্সেও। শুধু কেনাকাটা বা খাবারের জন্যই মানুষ যে এ সব শপিং মলে আসতেন বিষয়টি তা নয়; গল্প, আড্ডা, মিটিং, পাত্র-পাত্রী দেখা, প্রেমিক-প্রেমিকাদের সাক্ষাৎ করার স্থানও ছিল বেইলি রোড। সেই ব্যস্ততম বেইলি রোডে নেই মানুষের কোলাহল।
সোমবার (৪ মার্চ) সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা গেল, এক অচেনা বেইলি রোড। পুড়ে যাওয়া ভবনটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। আর সেই ভবনটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছে কিছু মানুষ। আবার চলতি পথে কেউ থেমে তুলছেন ছবি।
এদিকে রোববার (৩ মার্চ) রাত থেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হোটেল রেস্তরায় অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। বেইলি রোড তো বটেই গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, ওয়ারি থেকে শুরু করে প্রতিটি এলাকাতেই চলছে অভিযান। বেইলি রোডের ফুটপাথ থেকে চায়ের দোকানও তুলে দেওয়া হয়েছে।
চায়ের দোকানদার মশিউর সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই দিন ধরে চোর-পুলিশ খেলা চলছে বেইলি রোডে। দোকান নিয়ে বসে টানা দুই ঘণ্টাও থাকা যাচ্ছে না। কেরোসিন ব্যবহার করে চা বানিয়ে বিক্রি করছি, তার পরেও বসতে দিচ্ছে না। ক্রেতাদের কাছ থেকে চায়ের দাম না নিয়ে ভাগতে হয় কখনো কখনো।’
এ ছাড়া, পুলিশের অভিযানের কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে ‘বার্গার এক্সপ্রেস’, ‘সুলতান ডায়েন’, জিলেটোসহ অনেক খাবারের দোকান। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন রেস্টুরেন্ট মালিকরা।
অপরদিকে, অবৈধ হোটেল রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানকে হয়রানি হিসেবে উল্লেখ করেছেন রেস্তরা মালিক সমিতির নেতারা। বাংলাদেশ রেস্তরা মালিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ ইমরান হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছি। হয়তো কিছু ব্যবসায়ীর লাইসেন্স পেতে দেরি হয়েছে। এটা তো তাদের দোষ নয়। কারণ, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর তো লাইসেন্স পেতে কোনো ধরনের সহযোগিতা করছে না।’
তিনি বলেন, ‘দিনে দিনে এই খাত বড় হয়েছে। আজ যদি এই পরিস্থিতি হয় তাহলে কেন বড় হতে দিলেন। মানুষ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে সেখানে। এখন এমন আচরন করছেন যেন আমরা দেশের অনেক বড় সন্ত্রাসী। আজও চট্টগ্রামর একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। খুঁজে দেখা হোক নিশ্চয়ই সেখানে কোনো ঘাটতি ছিল। আমি উদাহরণ দিচ্ছি না। এতগুলো মানুষ মারা গেছে। কেউ চায় না ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাক।’
সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সহযোগিতা কামনা করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনেকবার কথা বলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি। অনেক চিঠি দিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত পারিনি। এখন তো সবচেয়ে বড় অপরাধী হয়ে গেলাম।’ বেইলি রোডে অগ্নি দুর্ঘটনা ও যারা অবৈধ নিরাপত্তাহীনভাবে ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে চলমান হয়রানি বন্ধের অনুরোধ জানান ইমরান হাসান।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯ টা ৫০ মিনিটের দিকে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩ ইউটিনের প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সেই সঙ্গে সহযোগিতায় নামে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া, আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১১ জন। তারা কেউ-ই শঙ্কামুক্ত নন।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম