মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’, অভিযান প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন
২৫ মে ২০১৮ ১০:৩৫ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ২০:০৩
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। তবে গত কয়েকদিনে এ অভিযান চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গত ১০ দিনে মারা গেছেন ৫০ জনের বেশি।
পুলিশের দাবি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য এবং আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে।
তবে মানবাধিকার সংগঠনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রশংসনীয় হলেও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনা সমর্থনযোগ্য নয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একের পর এক মাদক ব্যবসায়ী নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ জানাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এসেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল মঙ্গলবারও (২২ মে) তার নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবারের অভিযানে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ী যেই হোক তার বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। তরুণ প্রজন্ম বাঁচাতে এটি সরকারের স্পষ্ট অবস্থান।’
মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার সরকারকে সহযোগিতা করছে না— এ তথ্য জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ দু’টি থেকে আমাদের দেশে মাদক ঢুকছে। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা সহযোগিতা করছে না। বাধ্য হয়েই আমরা এ অভিযান চালাচ্ছি।’
বৃহস্পতিবার (২৪ মে) রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে বিআরটিসি পরিবহনের কার্যক্রম পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানকে সমর্থন করি। আমার প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, আমি সমর্থন করব না? এই অভিযানে সারাদেশের মানুষ খুশি। তাহলে আমি সমর্থন করব না কেন, এটা কেমন প্রশ্ন?’
এদিকে বিএনপি অভিযোগ করেছে মাদক বিরোধী অভিযানের নামে সরকার বেছে বেছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হত্যা করছে।
অভিযান বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কেবল মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
চলমান অভিযান প্রসঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সরকার যে কোনো মূল্যে দেশকে মাদকমুক্ত রাখতে চায়। সে জন্য আমরা শক্ত অবস্থান নিয়েছি। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সারাদেশের মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে র্যাব-পুলিশের সমন্বিত অভিযান চলছে।’ দেশের সাধারণ মানুষ এ অভিযানকে সমর্থন করছে বলে দাবি করেন তিনি।
মাদকের বিরুদ্ধে সরকারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির প্রশংসা করলেও অভিযানের ধরন নিয়ে সমালোচনা করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, দেশের মাদকবিরোধী আইন থাকার পরও অভিযানের নামে এমন হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়। এর মাধ্যমে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত গডফাদারদের আড়াল করা হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাদকের ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। মাদক নির্মূলে কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যেকোনো অপরাধীকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আবার আত্মপক্ষ সমর্থন করাও নাগরিকের মৌলিক অধিকার। একজন খুনিও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখেন। বিনাবিচারে সাজা বা হত্যা সমাজের জন্য কোনো শুভ খবর না।’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ‘মাদক নির্মূলে বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। এই পথে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। মাদক ব্যবসা যারা করে, তারা তো ভয়ঙ্কর। অভিযানের সময় গোলাগুলিতে কেউ কেউ মারা যেতে পারে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এদের মদদ দিচ্ছে কারা, এর মূলে কারা রয়েছে—তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে হবে।’
পুলিশের আরেক সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল আনোয়ার বলেন, ‘ধরে আনার পর ক্রসফায়ারে যেসব মাদক বিক্রেতা মারা যাচ্ছেন, তারা আসলে মাদক রাজ্য নিয়ন্ত্রণে কতটুকু ভূমিকা রাখেন, তা ভাবনার বিষয়। মাদক পাচারের সঙ্গে সংসদ সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ বেশ পুরনো। তাদের বিষয়ে আগে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ভারত ও মিয়ানমার দিয়ে বাংলাদেশে মাদক আসছে। তাহলে কি ধরে নেব, সীমান্তে যেসব বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে তারা মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত? তাহলে তাদের বিচার কে করবে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারাদেশে মাদকের বিস্তারের পেছনে রাজনৈতিক মদদ রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীরা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে। তাই তাদের দমনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। তবে বর্তমানে যে উপায়ে তাদের নির্মূলের চেষ্টা চলছে, সেটি সমর্থনযোগ্য নয়।’
মাদক নির্মূল করতে হলে প্রথমে এর উৎসে হাত দিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক জিয়া। গডফাদারদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হলে সারাদেশে মাদকের বিস্তার ঠেকানো যাবে বলে মনে করেন এ অপরাধ বিজ্ঞানী।
তবে চলমান মাদক বিরোধী অভিযানকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হিসেবে দাবি করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কোথাও কোথাও অপরাধীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ছে বলে শুনছি, এমনটি হলে তারা আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে বিষয়টি মনে রাখতে হবে একজন অপরাধীরও মানবাধিকার থাকে। যে কোনো পরিস্থিতিতে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
সারাবাংলা/এমএস/টিআর/একে