রওশনের সম্মেলনে যাচ্ছেন না রংপুরের অধিকাংশ নেতা
৫ মার্চ ২০২৪ ১৫:৫৬
রংপুর: রওশন এরশাদের পৃথকভাবে জাতীয় পার্টির (জাপা) জাতীয় সম্মেলনের ঠিক চারদিন আগে তাতে না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত দলের সাবেক প্রভাবশালী নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। এ কারণে রওশনের সম্মেলনে যাচ্ছেন না দলটির রংপুরের অধিকাংশ নেতা। একইসঙ্গে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে সমর্থন দিয়ে মূল দলের ফেরার ইঙ্গিত দেন তিনি। এর মধ্যে দিয়ে রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত এই নেতা দীর্ঘদিনের অবস্থান পরিবর্তন করলেন।
নিজের এই অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি মঙ্গলবার (৫ মার্চ) একটি জাতীয় গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন রাঙ্গাঁ। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও দলের বাইরে গিয়ে ডাকা এই কাউন্সিল অবৈধ ও গঠনতন্ত্রবিরোধী। তাই আগামী ৯ মার্চ জাপার নামে রওশন এরশাদ যে কাউন্সিল অধিবেশন ডেকেছেন, তাতে থাকছি না। রাজনীতি করলে মূল জাতীয় পার্টির করব। অর্থাৎ যেখানে লাঙ্গল আছে, সেই দলই করব। দলের বাইরে গিয়ে অন্য কারও সঙ্গে রাজনীতি করতে চাই না। আমি তামাশার পাত্র হতে চাই না।’
জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই। তবে রাজনীতির মাঠে দীর্ঘদিন ধরে জি এম কাদেরের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে দলের পৃষ্ঠপোষক এরশাদপত্নী রওশনের। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। ফলে নির্বাচনে রওশন এরশাদ ও তার ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ) নির্বাচনে অংশই নেননি।
জাতীয় নির্বাচনের পর আগামী ৯ মার্চ নিজের অনুসারী নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতীয় সম্মেলন করার ঘোষণা দেন রওশন। সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে দল থেকে বেরিয়ে আসা কাজী ফিরোজ রশীদকে। সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাকে সহ-আহ্বায়ক এবং সফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করা হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাপার নীতিনির্ধারণী পর্ষদ প্রেসিডিয়ামের জরুরি সভা ছিল ২ মার্চ। অন্যদিকে ৯ মার্চ জাপার নামে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশন ডাকার পর থেকেই জাতীয় পার্টিতে উত্তেজনা দেখা দেয়। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, নেতৃত্ব নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো আপস না হলে জাপায় আরেক দফা ভাঙন হতে পারে। এরই মধ্যে দুটি গ্রুপই নিজের শক্তি ও অবস্থান জানান দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে।
জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানিয়েছেন, কাউন্সিল অধিবেশন সামনে রেখে রওশন এরশাদ দলের সাবেক, নিষ্ক্রিয় এবং বাদ পড়া নেতাদের সংগঠিত করছেন। অন্যদিকে জি এম কাদের দলে নিজের অবস্থান আরও শক্ত করতে কাউকে পদোন্নতি, আবার অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের কাউকে স্বপদে ফিরিয়ে আনছেন। ইতোমধ্যে দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী, সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেকার আহসান হাসান ও যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক আজহারুল ইসলাম সরকারের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি দুই সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১) ও শরিফুল ইসলাম জিন্নাহকে (বগুড়া-২) প্রেসিডিয়ামের সদস্য করেন জি এম কাদের। এর আগে তারা জাপার চেয়ারম্যানের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।
তবে রওশনপন্থিরাও বসে নেই। কাদেরপন্থিদের রওশনশিবিরে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চেষ্টা করছেন সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি ও অবস্থান জানান দেওয়ার। সে লক্ষ্যে জাতীয় পার্টির এক সময়ের দলের নীতিনির্ধারণী সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকেও পাশে চান রওশনপন্থি নেতারা। এখনো রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে তার ঘনিষ্ঠজনরা রাঙ্গাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে রাঙ্গাঁ বলেন, ‘রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে তার ঘনিষ্ঠজনরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তবে রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টি আর করতে চাই না। জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরসহ পুরো বিভাগের আট জেলা থেকে দলের শীর্ষ নেতা, প্রেসিডিয়ামে সদস্য ওই কাউন্সিল অধিবেশনে অংশ নেবে না। এখানে রওশনের পক্ষে নেতাকর্মী নেই। এমনকি তার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ভেঙে আলাদা দল হলেও তাতে এই অঞ্চলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও মানুষের সমর্থন পাবে না। একেবারেই না। কারণ রংপুরের মানুষ দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি এখনো সহানুভূতিশীল।’
আর হাসির পাত্র হতে চাই না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির মূল পরিচয় দলের প্রতীক লাঙল। অথচ সেটি পার্টির চেয়ারম্যানের হাতে। ফলে দলের প্রতীক লাঙল ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই রওশন এরশাদের। কাজেই তার কাউন্সিলে যোগ দিয়ে নিজেকে আর বিতর্কিত করতে চাই না, অনেক হয়েছে।’
এদিকে রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতারাসহ বিভাগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী জি এম কাদেরপন্থি হিসেবে পরিচিত। রওশনপন্থিদের কোনো তৎপরতা রংপুরে বিভাগে নেই। তবে রওশন এরশাদের ঘোষিত সম্মেলনে যাতে কেউ যোগ দিতে না যান, সে ব্যাপারে নজর রাখছেন জি এম কাদেরপন্থি নেতারা। এর অংশ হিসেবে নেতারা তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগও শুরু করেছেন।
জেলা জাতীয় পার্টির সদস্যচিব ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘রওশন এরশাদের সম্মেলন নিয়ে নিয়ে রংপুরের রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশা দেখা দিয়েছে, তবে আমরা বসে নেই কেউ। কেউ যেন রওশনের ডাকা কাউন্সিলে যেতে না পারেন, এ জন্য সার্বক্ষণিক মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘রওশন এরশাদপন্থিরা দল ভারীর চেষ্টা করছেন। এগুলো নাটক। রংপুর বিভাগের কোনো নেতা তাদের কাউন্সিল অধিবেশনে যাবে না। এখানে সব নেতাকর্মী দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের পক্ষে আছেন।’
প্রসঙ্গত, দলের দুই নেতার দ্বন্দ্বে রওশন এরশাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় আসেন মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। এর রেশ ধরে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রাঙ্গাঁকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেন জিএম কাদের। এরপর থেকে ‘রওশন বলয়ের নেতা’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। একাধিক অনুষ্ঠানে রওশনের সঙ্গে দেখা যায় তাকে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনজনের জন্য দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন রওশন এরশাদ। কিন্তু সেখানে রাঙ্গাঁর নাম ছিল না। মনোনয়ন পেতে জি এম কাদেরের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করলেও সাড়া পাননি রাঙ্গাঁ। এ অবস্থায় রওশন ও জি এম কাদেরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করলেও কোনো সমঝোতা হয়নি। সবশেষে রওশন ও রওশনপুত্র সাদ এরশাদ নির্বাচন অংশ নেননি। তবে রাঙ্গাঁ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রংপুর-১ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। এই আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান বাবলুর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন তিনি।
রাঙ্গাঁপন্থি এক নেতা জানান, আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত নির্বাচনি এলাকা গঙ্গাচড়ার বাসায় থাকবেন রাঙ্গাঁ। এলাকার নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আবারও মূল দলে ফিরতে চান।
সারাবাংলা/আরএইচএস/এনএস
জাতীয় পার্টি জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ রওশন এরশাদ