৭ মার্চ ১৯৭১: পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রণ-কৌশল ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু
৭ মার্চ ২০২৪ ১১:০৪
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানান— ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-সমাবেশ করা হবে, সেখান থেকেই দেওয়া হবে চূড়ান্ত দিক-নির্দেশনা। সেই মুহূর্ত থেকে সাত কোটি বাঙালি ৭ মার্চ দিনটির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। অতঃপর ৭ মার্চ দশ লক্ষাধিক মানুষের উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিনের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রণ-কৌশল ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সেদিনের সেই ভাষণটিই এখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ ও বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য বলে স্বীকৃত। গোটা বিশ্বের জন্য এই ভাষণটিকে একটি প্রামাণ্য দলিল বলে অভিহিত করেছে ইউনেস্কো। কারণ, এটি শুধু কোনো রাজনৈতিক ভাষণ নয়। এই ভাষণটিতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের ভাগ্য বদলের কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অসহযোগ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে অস্ত্রের মোকাবিলায় প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহারের জন্যে ঘরে ঘরে প্রস্তুতি ও গণপ্রতিরোধের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে এই ভাষণে।
নিয়মতান্ত্রিক অথচ পুরোদস্তুর গেরিলা যুদ্ধ-প্রস্তুতির ঘোষণা, বিপ্লবের ডাক অথচ পুরোপুরি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাত কোটি জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা— এটি শুধু ৭ মার্চের ভাষণেই সম্ভব হয়েছে। এ কারণে বিশ্ববাসীর কাছে আজ এই ভাষণ একটি অনবদ্য বিশ্ব-ঐতিহ্য। আর আমাদের কাছে এই ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রণ-কৌশল ও দিক-নির্দেশনা।
বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সকাল থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে ঐতিহাসিক ভবনে ভিড় জমাতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা। ছাত্রনেতাদের ভিড় ছিল পুরো সময়। এ সময় নিজ বাসভবনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ছাত্র নেতাদের তিনি জানান, বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে চার দফা দাবি পেশ করা হবে।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ জানান, ৬ মার্চ সন্ধ্যায় ও ৭ মার্চ দিনের বেলা রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে শুধু চার দফার ব্যাপারেই আলোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাকি কথাগুলোর কোনো ড্রাফট ছিল না। ৭ মার্চের ভাষণ নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন তিনি। দুপুর ২টার পর বঙ্গবন্ধু যখন ৩২ নম্বরের বাসা থেকে বের হন, তখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তাকে (বঙ্গবন্ধু) বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস কর, তাই বলবে।’
তোফায়েল আহমেদ আরও জানান, ৭ মার্চ সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে সকাল থেকেই গণসঙ্গীত চলছিল। সেদিন সভামঞ্চে শেখ মুজিবুর রহমান একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন।
৭ মার্চের জনসভার জন্য রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ২টা। কিন্তু ১১টার মধ্যেই রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধুর ফুপাতো ভাই মমিনুল হক খোকা ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল, বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও আমি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটি চালিয়েছিলাম আমি।’
বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া এবং বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাকের ওপর। তখন তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান। আর রেসকোর্স ময়দানে সভামঞ্চের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার এবং ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার নায়ক কামরুল আলম খান খসরু।
আব্দুর রাজ্জাক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘সকাল থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। ঠিক হয় তিনটি গাড়ি এক সঙ্গে রেসকোর্স ময়দানে যাবে। দুইটি গাড়িতে থাকবে যাদের গোঁফ আছে এবং তাদের পরনে থাকবে পাঞ্জাবি। চুল থাকবে ব্যাক ব্রাশ করা। সামনের গাড়িতে থাকবে ছাত্রনেতারা। ঠিক ২টার সময় ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বের হন বঙ্গবন্ধু। ৩২ নম্বর থেকে এলিফ্যান্ট রোড ও তৎকালীন পিজি হাসপাতালের পাশ দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার কথা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে তা বদলে ফেলা হয়। এরপর নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু।’
বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে রেসকোর্স ময়দানে নেওয়া এবং মঞ্চের নিরাপত্তা সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায় কামরুল আলম খান খসরুর লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তিনটি দল গঠন করা হয়েছিল। একটি দল বঙ্গবন্ধুকে বাসা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আনা-নেওয়া করার জন্য। ভাষণের সময় মঞ্চের নিচে থাকার জন্য ছিল একটি দল। মঞ্চের আশপাশে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখার জন্য ছিল আরেকটি দল।
সমাবেশ শেষে সোজা পথে ধানমন্ডি না ফিরে শাহজাহানপুর, মতিঝিল কলোনির পাশ দিয়ে শেরেবাংলা নগর হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার বহরটি ফেরে ৩২ নম্বরের বাড়িতে। এত নিরাপত্তার কারণ হিসেবে তারা সবাই জানিয়েছেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছিল চারিদিকে। বলা হয়েছিল, কমান্ডো অ্যাটাক করে হত্যা করা হবে বঙ্গবন্ধুকে। আকাশে হেলিকপ্টারও ঘুরছিল। অ্যাটাক হলে বাঁচানো যেত না তাকে। তাই এই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে।
ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘৭ই মার্চ ভাষণের পর বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খান বঙ্গবন্ধু। সে সময় তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, আমার যা বলার ছিল, আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুই বেলা আমার সঙ্গে খাবে।’
তথ্যসূত্র: আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
সারাবাংলা/জেআর/এনএস