Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাধা সমাজ-রাষ্ট্র, গন্তব্য বহু দূর

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৮ মার্চ ২০২৪ ১৪:৫৯

ঢাকা: একজন নারী মানুষ হয়ে জন্মায়, মানব সন্তান হয়ে জন্মায়। আর এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। নারী-পুরুষ সমঅধিকারের বিষয়টি এখনো অনেকাংশে কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। আমাদের সংবিধানেও বলা হয়েছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু এটি যখন বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয় তখনই শুরু হয় যত বিপত্তি। নারী-পুরুষের সমান সুযোগ, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখনো গোড়ার সমস্যা।

বিজ্ঞাপন

নারীর প্রতি বৈষম্য বা অসমতা দূর করতে পারে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আরও বেশি উপস্থিতি। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর বাংলাদেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করলেও এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সবশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুসারে দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা (১৬ লাখ ৩৪ হাজার) বেশি। আবার কর্মক্ষম হিসেবে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বা ২৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। প্রতিফলন নেই অন্যান্য অধিকারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও।

বৈশ্বিক জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা এখনো প্রায় ২৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বৈষম্য অর্থনীতি ও রাজনীতিতে। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য এখনো ৫৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯তম। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী-পুরুষের বৈষম্য ৪৫ শতাংশ।

অধিকারকর্মী ও গবেষকরা বলছেন, এই বৈষম্য কমাতে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগও যথেষ্ট নয়। রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা পুরুষের সমান সুযোগ, সম্মান, ছাড়, গ্রহণযোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ পাচ্ছেন না। নারীর রাজনৈতিক যাত্রাপথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক বাধা ও দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা।

একজন নারী রাজনৈতিক কর্মীকে চরিত্রহনন, অপপ্রচার, সহযোগিতার অভাবের মতো সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়। অন্যদিকে পুরুষ রাজনীতিবিদরা পেশীশক্তি, অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও চলাচলের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা ভোগ করেন। এর প্রভাব পড়ে রাজনৈতিক পদ-পদায়নের ক্ষেত্রেও। তবে এটি মানতে নারাজ রাজনীতিবিদরা। তারা বলছেন, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিই এখনো নারীবান্ধব না হওয়ায় পর্যাপ্তসংখ্যক নারী রাজনীতিতে আসছেন না। এর ফলে পদায়ন ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নারী পাওয়া যায় না। এটি রাজনীতির চেয়েও সামাজিক সমস্যা বলে মনে করছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ সারাবাংলাকে বলেন, রাজনৈতিক সংগঠনে পদায়ন বা সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নয়, কে কত ভোট আনতে পারবে সেটিই বিবাচনা করা হয়। বর্তমান ট্রেন্ড অনুযায়ী নারীরা সবক্ষেত্রেই এগিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দল ও সরকার ছাড়াও প্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ সব ক্ষেত্রেই নারীদের তুলে ধরছেন।

যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে জাতীয় মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, দল ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীদের পদায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা দেখা যায়। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের জন্য তা যথেষ্ট নয়।

সমাজবিজ্ঞানী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. সাদেকা হালিম সারাবাংলাকে বলেন, গত ৫০ বছরে নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যের সংখ্যা ১৫ থেকে ৫০ করা হয়েছে। এসব সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনের মাধ্যমেই পরে সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা সেটি দেখতে পারছি না।

তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আইন (আরপিও) হওয়া সত্ত্বেও (রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী উপস্থিতি) রাজনৈতিক দলগুলো বলছে যথেষ্টসংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন নারী না থাকায় এটি পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, পুরুষ রাজনীতিবিদ আর নারী রাজনীতিবিদের যোগ্যতার মাপকাঠি এক নয়। সমাজে নারী ও পুরুষ সমান সুযোগ-সুবিধা পায় না। নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। তাই তাদের এগিয়ে আনা প্রয়োজন। নারীদের এগিয়ে আনার প্রক্রিয়াটিকে আমরা বলি পজিটিভ ইমানসিপেশন (ইতিবাচক মুক্তি)। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আমরা এবার সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে চারজন প্রতিমন্ত্রী পেয়েছি। নারীকে ক্ষমতায়িত করার এটিও একটি কৌশল।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা কৌশলে নারী নেতৃত্বকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দেখতে পারছি। তৃণমূল থেকে নারী নেতৃত্ব তুলে আনা হচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া বিএনপির মধ্যে সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। নারীদের কথা তারা আলাদাভাবে ভাবছে বলে মনে হয় না।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর পিছিয়ে থাকার কারণ

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীর পিছিয়ে থাকার পেছনে পেশীশক্তির অভাব, সম্পত্তির অধিকার না থাকা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক বাধা, জেন্ডার সমতা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শায়েখ ইমতিয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এটি সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারই অংশ। আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি পরিবর্তন দেখছি। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেসব দলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন, তা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টা রয়েছে জেন্ডার সমতা আনার। কিন্তু তিনি চাইলেও নারীর ক্ষমতায়ন দেখার মতো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরেই। তবু পুরুষরা এখনো নারীকে ক্ষমতায়িত নারী দেখতে প্রস্তুত না। তৃণমূলে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম।

রাজনৈতিক ও সামগ্রিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় রাজনীতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করেন এই শিক্ষক। বলেন, গণতন্ত্র দুর্বল হলে সমাজে ডানপন্থার চর্চা বেড়ে যায়। আমাদের সমাজেও চরম ডানপন্থি দলগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা নারীকে মেনে নেয় না। আবার কিছু দলের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও তারা নির্দিষ্ট একটি খাপেই নারীকে দেখতে চায় ও সেই বার্তাই প্রচার করে।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, গবেষণায় দেখেছি নারীরা পদ-পদবি চাইলে তাকে পুরুষের কাছেই যেতে হয়। পেশীশক্তি, লবিং, ক্ষমতা প্রদর্শন— এসব করে একজন নারীর জন্য টিকে থাকা কঠিন।

নারী অধিকারকর্মী ফওজিয়া মোসলেম সারাবাংলাকে বলেন, সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তৃণমূল ও মধ্যপর্যায়েও এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মনোভাবের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নারীরা এগিয়ে যেতে পারছে না। এখানে পেশীশক্তি, টাকার খেলা, সামাজিক প্রথা, দলের মধ্যে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার অভাব, নারীর হাতে অর্থ না থাকা, সম্পত্তির অধিকার না থাকা প্রধান প্রতিকূলতা।

এ বিষয়ে নারীপক্ষের সদস্য কামরুন্নানার বলেন, বর্তমান সময়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে আসছে। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও পাড়ার কমিটি থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ চোখে পড়ত। আর নারী রাজনীতিবিদরা কতখানি ক্ষমতার চর্চা করতে পারছেন তা এখনো নিশ্চিত নয়। আগের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কিছুটা বাড়লেও তা পর্যাপ্ত নয়।

সরাসরি নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণের হার হতাশাজনক। কোনো সংগঠনেই ৩৩ শতাংশ নারী রাখার বিষয়টি মানা হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে আরপিওর শর্ত পূরণ সম্ভব হবে না কিছুতেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নী মনে করেন, সম্পত্তির অধিকার না থাকায় নারীর হাতে টাকা নেই। তাই তারা ক্ষমতায়নে পিছিয়ে। পরিবার ও সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকা, কর্মস্থলে বৈষম্যের মতো কারণেও নারী পিছিয়ে পড়ে।

ফাহিমা নাসরিন বলেন, আমাদের রাষ্ট্র এখনো নারীবান্ধব নয়। এখনো নারীরা নিরাপদে পথ চলতে পারে না। যৌন নির্যাতনকে আমরা ইভটিজিং বলে ছোট করে দেখি। কিন্তু শুধুমাত্র রাস্তায় বের হলে হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে অনেক মেয়ে বাইরে আসতে নিরাপদ বোধ করে না।

রাজনৈতিক দলে নারীর অবস্থান

ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশ কম। ১৬ জন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের মধ্যে তিনজন নারী— মতিয়া চৌধুরী, জেবুন্নেসা হক ও সিমিন হোসেন রিমি। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চারজনের মধ্যে নারী একজন— ডা. দীপু মণি।

এর বাইরে বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকমণ্ডলী ১৯ জনের মধ্যে ছয়জন নারী। আটজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও দুইজন উপসম্পাদকের সবাই পুরুষ। ২৭ জন সদস্যের মধ্যে নারী আটজন, উপদেষ্টা পরিষদের ৪৬ জনের মধ্যে নারী পাঁচজন।

এ ছাড়া বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি ও সাধারণ সম্পাদক শবনম জাহান শিলা। আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনেরও নারীদের জন্য আলাদা শাখা রয়েছে। এসব শাখা ও অঙ্গসংগঠন থেকেও নারী রাজনীতিবদরা মূল দলে যাচ্ছেন। সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হচ্ছেন, আবার সংরক্ষিত মহিলা আসনেও অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রিসভায় ইতিহাসের সর্বোচ্চসংখ্যক নারী জায়গা পেয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া ৪৪ সদস্যের মন্ত্রিসভায় নারী মন্ত্রী আটজন, শতাংশের হিসাবে যা ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন দীপু মণি (সমাজকল্যাণমন্ত্রী), রুমানা আলী (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী), সিমিন হোসেন রিমি (মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী), রোকেয়া সুলতানা (স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী), শামসুন নাহার (শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী), ওয়াসিকা আয়শা খান (অর্থ প্রতিমন্ত্রী) এবং নাহিদ ইজাহার খান (সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, পূর্ণ দায়িত্ব)। এদের মধ্যে দীপু মনি, রুমানা আলী ও সিমিন হোসেন রিমি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত, বাকিরা সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

দলের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগের নারী সংগঠনগুলো কাজ করছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহিলা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। দলের মধ্যে পদ-পদবীর বাইরেও অনেক নারী আছেন, যারা সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী।

দলের মহিলা শাখা ছাড়া মূল দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর সম্ভাবনার বিষয়ে হানিফ বলেন, এখন হচ্ছে না, পরে হবে। তবে কতটা হবে সেটি সময় বলে দেবে। নারীদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই জায়গা করে নিতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মারুফা আক্তার পপি বলেন, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে নারী অনেক এগিয়েছে। আমি দলের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সিনিয়রদের অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। তবে আমাদের সমাজ এখনো নারীকে ক্ষমতার জায়গায় দেখতে অভ্যস্ত না। পরিবার, সমাজ সব ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থান এখনো অনেক নিচুতে। তবে আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছি।

পারিবারিক-সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরে পপি বলেন, সংগঠনের মধ্যে নারী হিসেবে আলাদা চোখে দেখা না হলেও পারিবারিক বাধা অনেক বড়। সামাজিক পরিস্থিতি আরও জটিল। নারী নেতা জেলে গেলে মা-বাবা হয়তো তার কষ্টের কথা ভেবে দুঃখ পায়। কিন্তু সমাজ বিষয়টিকে অনেক নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে, যা পুরুষের বেলায় হয় না। এসব নানা কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেক নারীই রাজনীতিতে আসতে সাহস পান না।

এদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ১৯ সদস্যের জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে একমাত্র নারী বেগম সেলিমা রহমান। ৮২ সদস্যের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের মধ্যে নারী ছয়জন— বেগম সারোয়ারি জাহান, অধ্যাপিকা তাজমেরী ইসলাম, অধ্যাপক ড. শহিদা রফিক, রোজী কবির, তাহমিনা রাশদীর লুনা এবং আফরোজা খানম। এ ছাড়া সম্পাদক, সহসম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ২০৩ জনের মধ্যে নারী ২২ জন।

বিএনপির ২৯৯ সদস্যের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে নারী ৪৫ জন। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ। এ ছাড়াও দলটির অন্যান্য অঙ্গসংগঠনেরও নারী বিষয়ক আলাদা শাখা রয়েছে।

বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নী বলেন, সাংগঠনিকভাবে নারীরা সংখ্যায় কম হলেও দুর্বল নয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সবসবময়ই নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ করে। অবৈতনিক শিক্ষা, উপবৃত্তি, নারী পুলিশ নিয়োগ দেওয়ার মতো কাজ আমরা ক্ষমতায় থাকতে করেছি। আর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু দলের ওপরেই নির্ভর করে না, সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর ওপরও নির্ভর করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যেমন নারীর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি রাষ্ট্রও নারীকে সামাজিক সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ।

তিনি বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অত্যন্ত কঠিন। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের ওপর এটি নির্ভর করে। নারীকে এগিয়ে আসতে তাই পুরুষের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি পরিশ্রম করতে হয়। পরিবার অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নারীর চরিত্রহননের চেষ্টা হয় বিরোধীপক্ষ থেকে। এসব দেখেশুনে অনেক পরিবারই আর মেয়েদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহ দেয় না।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ভবিষ্যত

নারীকে এগিয়ে নিতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নারীবান্ধব হতে হবে বলে অভিমত দিচ্ছেন রাজনৈতিক কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাষ্ট্রকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় নারীকে স্থান করে দিতে হবে। যোগ্য কোনো নারীকে কোনো অজুহাতেই বঞ্চিত করা যাবে না।

মহিলা পরিষদ সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বর্তমান যুগে রাজনীতি দেখে মনে হয় সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। এই সিন্ডিকেট পুরুষ নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধানকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। আর সেই সংবেদনশীলতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারলে নারীর কয়েক দশকের অগ্রগতি পিছিয়ে যাবে।

সাদেকা হালিম বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে নারীকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন, তা অনেকেই হয়তো বোঝেন না। ভবিষ্যত নেতৃত্ব পুরুষের হাতে গেলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদী সমাজে একার আয়ে সংসার চলে না। নারীকে কাজ করতেই হবে। আর সেই নারীকে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আনতে তার শিক্ষা ও অন্যান্য যোগ্যতার বিচার করতেই হবে। নারী হিসেবে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না কিছুতেই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় নারী না থাকলে কোনো অর্জনই সম্ভব হবে না।

অধ্যাপক ড. শায়েখ ইমতিয়াজ বলেন, রাষ্ট্রকাঠামোতে নারীর উপস্থিতি না থাকলে দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠি নারী পিছিয়ে থাকবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তরুণ নারীদের মন্ত্রিত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতায়িত করছেন। এটি দল ও দেশের জন্য তার দূরদর্শিতার প্রমাণ বলেই প্রতীয়মান। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অনেকটাই বিচ্ছিন্ন রাজনীতি করছে, যদিও তার মধ্যেও তাদের অনেক নারী নেতাকেই দলের জন্য উজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে।

বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরীন বলেন, বাংলাদেশের শুধু এক শতাংশ নারী ক্ষমতাধর। গ্রাম-গঞ্জের বাকি যেসব নারী, তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। রাজনীতিতে যোগ্যতার আলোকে পদায়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে সে উচ্চকিত হতে পারবে এবং নিজের অধিকার আদায় করে নিতে পারবে।

নারীপক্ষের কামরুন্নাহার বলেন, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ব্যতিক্রমধর্মী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আমরা নারীপক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, স্থানীয় পর্যায়ে অন্তত তিনটি আসন রাখতে হবে যেখানে কেবল নারীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এ ছাড়া নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ দিতে পুরস্কারভিত্তিক নয়, যোগ্যতার আলোকে পদায়ন করতে হবে। নানা প্রতিকূলতা পার করে তৃণমূলে যারা কাজ করছেন, তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সারাবাংলা/আরএফ/এনইউ

অধিকার ক্ষমতায়ন নারী রাজনৈতিক সমতা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর