‘স্থানীয় সরকার শক্তিশালী মানে কেন্দ্র থেকে বেশি টাকা পাওয়া নয়’
৯ মার্চ ২০২৪ ১৭:৪৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বেশি টাকা বরাদ্দ পাওয়া নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। আয়বর্ধন করে নিজেদের ব্যয় নিজেরাই বহন করলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে বলে তিনি মত দিয়েছেন।
শনিবার (৯ মার্চ) দুপুরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ষষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে মন্ত্রী এ কথা বলেন। নগরীর পাঁচলাইশে কিং অব চিটাগং ক্লাবে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মধ্যে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা নিয়ে ভুল অর্থ ও ভুল ব্যাখা দেওয়া হয়। এমনভাবে ব্যাখা করা হয় যে, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার অর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার বেশি টাকা বরাদ্দ দেবে। এটা কোনোভাবেই নয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হতে হলে তাদের আয়বর্ধন করতে হবে এবং সেখান থেকে নিজস্ব ব্যয় তাদের নিজেদেরই বহন করতে হবে। স্থানীয় উৎস থেকে অর্থ আহরণ করতে হবে।
আয়বর্ধন চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে এর পথও বাতলে দেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যদি এমনভাবে সেবা দেয় যে, নাগরিক আশ্বস্ত হয়, তাহলে তিনি টাকা দিতে দ্বিধাবোধ করবেন না। বেনিফিট পেলে আপনি যখন রেভিনিউ সার্চ করবেন, তখন তিনি দ্বিমত করবেন না। যেমন- একটি বাজারে যদি নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্যোগ নেন, এতে একজন ব্যবসায়ীরা যদি ১০ হাজার টাকা সেভ হয়, তিনি আপনাকে ৫০ টাকা দিতে দ্বিধাবোধ করবেন না।’
‘মানুষের বাসা-বাড়ির পাশে নাল-নর্দমাগুলো যদি আপনি নিয়মিত পরিস্কার রাখেন, তাদের যদি আপনি সঠিক সেবাটা দেন, তাহলে তিনি আপনাকে রেভিনিউ দিতে দ্বিমত করবেন না। আবার কিছু কিছু মানুষের কোনো আয়-রোজগার নেই, শারীরিক ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে, তার জন্য যদি আপনি ইনকাম জেনারেশন করতে পারেন, তাহলে তিনি আপনাকে তার আয় থেকে কিছু অংশ দিতে দ্বিমত করবেন না।’
সরকার বরাদ্দ দিলেও সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প অনুমোদন এবং অর্থ বরাদ্দ সরকার দেবে, ঠিক আছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এসে সেটা বাস্তবায়ন করে দেব না। সেটা বাস্তবায়ন ও সুফল ভোগের উপযোগী করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে।’
কাজের মান এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতে চসিককে সকল সড়কের ডিজিটাল নথি নম্বর নির্ধারণের তাগিদ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিটি রাস্তার আইডি নম্বর থাকতে হবে। তাহলে আমার অফিস আপডেট থাকবে যে, এই রাস্তা কতদিন আগে নির্মাণ করা হয়েছে এবং আবার কতদিন পরে নির্মাণ করতে হবে। তাহলে এ সুবিধাটা হবে যে, বাজেটের ব্যবস্থাটা রাখতে পারবেন, একই রাস্তা বারবার নির্মাণ করার সুযোগ থাকবে না, কোনোভাবে ডিমলিউশনের সুযোগ থাকবে না এবং মেলপ্র্যাকটিস বন্ধ হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অনেক ভালো ভালো কাজ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সব কাজের মধ্যে এখন এডিস মশাটা আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে। ডেঙ্গু রোগে আমাদের প্রচুর লোক মারা গেছে। আগে ঢাকার দিকে এটার প্রকোপ ছিল। এখন তো ঢাকার বাইরে এমনকি রুরাল এরিয়াতেও এডিস মশার প্রকোপ বাড়ছে। চট্টগ্রামেও গতবার অনেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। হাজার প্রকারের মশা আছে পৃথিবীতে, বাংলাদেশে আছে তিন প্রকারের-এনাকিউলিস, কিউলিস এবং এডিস। আমাদের দেশে আগে এডিসের প্রকোপ তেমন ছিল না। এখন প্রচুর এডিসের প্রকোপ দেখতে পাচ্ছি।’
‘এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব আছে। ৯৮ পারসেন্ট এডিস মশা পরিস্কার পানিতে হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব আছে। সিটি করপোরেশন ফগিং করে, স্প্রে করে। এত কিছু করেও সেটা মোকাবেলা করা যবে না। অন্য মশা আপনি স্প্রে করে মারতে পারবেন, এডিস নয়। তিনদিনের জমা পানি যদি ফেলে দেন, তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করবে বলে আশা রাখি।’
চসিক মেয়রের দাবির প্রেক্ষিতে নগরীর নিউমার্কেট, ইপিজেড ও বহদ্দারহাটে আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য প্রিলিমিনারি স্টাডি করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনসহ প্রকল্প প্রস্তাবনা দাখিলের নির্দেশ দেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী।
চট্টগ্রামকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ধরে প্রধানমন্ত্রী বেশি অর্থ বরাদ্দ দেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘চট্টগ্রামের প্রায়োরিটি হচ্ছে, এখানে একমাত্র সমুদ্রবন্দর আছে, আমাদের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। আজকের অর্থনীতির চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে আমাদের আরও কিছু নতুন সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। তাইওয়ান, মাত্র ১৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটা দেশ, সেখানে চারটা বন্দর। সুতরাং একটা বন্দর দিয়ে বাংলাদেশকে উন্নত করা যাবে না। এ বিষয়টাকে মাথায় রেখে মাতারবাড়িতে একটা বন্দর হচ্ছে। আরও কয়েকটা বন্দরকে নতুন করে ইনকরপোরেট করা হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামের গুরুত্ব এরপরও কমে যায়নি এবং কমে যাবে না। আগামীতেও চট্টগ্রামের উন্নয়নের চাহিদা মাথায় রেখে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেওয়া হবে।’
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বিগত সময়ে চেয়ে আমরা ২৫ কোটি টাকা বেশি হোল্ডিং ট্যাক্স এবার আদায় করেছি। আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আমরা পেয়েছি, এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আপনি (মন্ত্রী) বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন বলেই পেয়েছি। চট্টগ্রামের কোনো সমস্যা নিয়ে আমরা গেলে আপনি নিরাশ করেন না। চট্টগ্রামের সব সমস্যা আপনি অবগত আছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নিজের অর্থায়নে ৮২টা স্কুল পরিচালনা করছে। চিকিৎসা কেন্দ্র, কম্পিউটার ট্রেনিং, নার্সিং ইনস্টিটিউট আছে। আপনার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এগিয়ে যাবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, আপনি আমাদের পাশে থাকবেন। চট্টলবাসী আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।’
সমাবেশে চসিকের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। একটা সময় সিটি করপোরেশনে অফিশিয়াল কাউন্সিলর ছিল। এ অফিশিয়াল কাউন্সিলর হতো বন্দরের চেয়ারম্যান, ওয়াসার চেয়ারম্যান, সিডিএর চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রধান কর্মকর্তারা। তাদের সিটি করপোরেশনের কাছে জবাবদিহি করতে হত। বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে সেটা বিলুপ্ত করে দেয়। আমার দাবি, আবারও সে অফিশিয়াল কাউন্সিলর ব্যবস্থা চালু করা হোক। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকার সব মার্কেট চালায় সিটি করপোরেশন। আর চট্টগ্রামে চালায় সিডিএ। আমি অবিলম্বে দাবি জানাই, সব মার্কেট সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হোক।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফ, আবদুচ ছালাম ও মহিউদ্দিন বাচ্চু, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শের আলী, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারি হাই কমিশনার রাজীব রঞ্জন, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. তৌহিদুল ইসলাম, প্যানেল মেয়র আফরোজা কালাম, মো. গিয়াস উদ্দিন ও আবদুস সবুর লিটন এবং নগর পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার মজুমদার।
সারাবাংলা/আইসি/ইআ