Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেসিসের লেনদেনে অনিয়মের অভিযোগ, ইজিএম না করেই অডিট ফার্ম বদল

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১০ মার্চ ২০২৪ ২৩:১৩

ঢাকা: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) আর্থিক লেনদেনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত বেসিস সফটএক্সপো আয়োজনে দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই কোটি টাকার বিল প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে পরিশোধ না ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করা হয়েছে।

সম্প্রতি বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সামনে রেখে পাঠানো নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে বেসিস সদস্যরা বিষয়টি জানতে পেরেছেন। এর সূত্র ধরে অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আগের এজিএমে সাধারণ সদস্যদের অনুমোদিত নির্ধারিত অডিট ফার্ম বিধি বহির্ভূত এই লেনদেন নিয়ে আপত্তি তোলায় তাদের বাদ দিয়ে অন্য একটি অডিট ফার্মকে দিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। নির্ধারিত অডিট ফার্মকে বাদ দিয়ে নতুন অডিট ফার্ম নিযুক্ত করার প্রক্রিয়াতেও গঠনতন্ত্র অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি নতুন অডিট ফার্ম নিযুক্ত করার বিষয় নিয়ে বেসিসের কার্যনির্বাহী কমিটির (ইসি) কোনো বৈঠকেই কোনো আলোচনা হয়নি।

আর্থিক লেনদেনে বিধিভঙ্গ এবং অননুমোদিত অডিট ফার্মকে দিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি তো বটেই, সদস্যদের কাছে পাঠানো নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি বেসিসের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের দিয়েও অনুমোদন করানো হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে লিখিত আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানিয়েছেন বেসিস কার্যনির্বাহী কমিটির তিন পরিচালক।

আগামী শনিবার (১৬ মার্চ) বেসিসের এজিএম তথা বার্ষিক সাধারণ সভার তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। ওই এজিএমের আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষিত প্রতিবেদন হিসেবে বেসিস থেকে পাঠানো হয় সদস্যদের কাছে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেসিস সফটএক্সপো ২০২৩ আয়োজনে খরচ হয়েছে প্রায় চার কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রায় দুই কোটি টাকার বিল প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে পরিশোধের নিয়ম মানা হয়নি বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। নবগঠিত অডিট কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে খোদ ইসির ভেতর থেকেই।

বেসিস থেকে পাঠানো নথিপত্র থেকে সদস্যরা জানতে পারেন, এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে অডিট ফার্ম অধিকারি অ্যান্ড কোং। অথচ গত এজিএমে বেসিস সদস্যরা অডিট ফার্ম হিসেবে মিজান অ্যান্ড কোং নামের প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছিলেন। বেসিস সদস্যরা বলছেন, অডিট ফার্ম পরিবর্তন করতে হলে কার্যনির্বাহী কমিটিকে বিশেষ বর্ধিত সভা (ইজিএম) আয়োজন করতে হবে। সেই সভায় সদস্যদের অনুমোদন নিয়ে তবেই অডিট ফার্ম পরিবর্তন করা যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর কোনো প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হয়নি।

বেসিসের একাধিক পরিচালক সারাবাংলাকে জানান, ইজিএম আয়োজন তো দূরের কথা, বেসিসের কার্যনির্বাহী কমিটির কোনো বৈঠকে অডিট ফার্ম পরিবর্তন নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। এজিএমে অনুমোদিত অডিট ফার্মকে বদলে নতুন অডিট ফার্ম নিযুক্ত করার বিষয়ে সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানোও হয়নি।

বেসিস সূত্রে জানা যায়, এজিএম সামনে রেখে আমন্ত্রণ ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন নথিপত্র সদস্যদের পাঠানোর পর গত শনিবার (৯ মার্চ) বেসিসের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক ছিল। সেখানে অডিট ফার্ম পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ। একপর্যায়ে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ ও সহসভাপতি (অর্থ) ফাহিম আহমেদ জানান, আগের অডিট ফার্ম মিজান অ্যান্ড কোং যেসব অডিট আপত্তি দিয়েছে, তা পূরণ করতে হলে এক কোটি ছয় লাখ টাকা বাড়তি কর দিতে হবে। এই কর এড়ানোর জন্যই নতুন অডিট ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বেসিস ইসির ওই বৈঠকেই অডিট ফার্ম পরিবর্তন করে নতুন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করানো নিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন বেসিসের তিন পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল, রাশাদ কবির ও মুশফিকুর রহমান। এই আপত্তির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর (আরজেএসসি) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগে (ডিটিও)।

জানতে চাইলে বেসিস পরিচালক রাশাদ কবির সারাবাংলাকে বলেন, এজিএমে নির্ধারণ করা অডিট কোম্পানিকেই অডিট করতে হবে। কোনো কারণে ওই কোম্পানি অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে বিশেষ বর্ধিত সভা (ইজিএম) আয়োজন করে নতুন কোম্পানি নির্ধারণ করতে হবে। অথচ এসব কিছু না করেই নতুন অডিট ফার্ম নিয়োগ দিয়ে অডিট করানো হয়েছে। পুরাতন ফার্মকে বাদ দেওয়া ও নতুন ফার্ম নিয়োগের পুরা ব্যাপারটিই বেসিস ইসিকে (কার্যনির্বাহী কমিটি) অন্ধকারে রেখে করা হয়েছে। অনুমোদন তো দূরের কথা, ইসিতে কোনো আলোচনাই হয়নি।

রাশাদ কবির আরও বলেন, অডিট রিপোর্ট পাস হওয়ার আসে ইসিতে উঠতে হয়। সেখানে ইসির অনুমোদনে অডিট রিপোর্ট পাস হতে হয়। কিন্তু এর কোনোটিই করা হয়নি। পুরোপুরি অবৈভাবে নতুন একটি কোম্পানির তৈরি অডিট রিপোর্ট আমাদের আড়াই হাজার সদস্যকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ সর্বশেষ এজিএমে অডিট ফার্ম হিসেবে যে চারটি কোম্পানির প্রস্তাব ছিল, সেই চারটি কোম্পানির মধ্যে অধিকারী অ্যান্ড কোং-এর নামই ছিল না।

‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন জানিয়ে রাশাদ কবির বলেন, বেসিস সফটএক্সপো ২০২৩-এর সময় দুটি কোম্পানিকে প্রায় দুই কোটি টাকার ক্যাশ চেক দেওয়া হয়েছে। অথচ এটি সম্পূর্ণ অবৈধ। এটা নিয়েও আমি বেসিসের বোর্ড মিটিংয়ে প্রদিবাদ জানিয়েছি, ইমেইলও করেছি। কোনো ট্রেড বডিতে এতটা অনিয়ম হতে পারে না। তাই আমরা তিনজন পরিচালক এই অডিট রিপোর্টের ওপর নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি। কারণ এমন ঘটনা ঘটলে বোর্ডে যারা রয়েছেন, আগামী ছয় বছর তাদের কেউ আর কোনো ট্রেড বডিতে নির্বাচন করতে পারবেন না। বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের দায় আমরা নিতে পারি না, সেই দায় আমি নেব না। তাই সব নিয়ম মেনে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি।

বেসিসের আরেক পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, আমরা যে অডিট রিপোর্ট হাতে পেয়েছি, সেই অডিটর আমাদের এজিএমে পাস করা অডিটর নয়। তাই নিয়ম মেনে আমরা ইসির ভেতরেই প্রতিবাদ করেছি। বেসিসের সব নিয়ম মেনে আমরা আপত্তি দিয়েছি।

জানতে চাইলে বেসিস সেক্রেটারি হাশিম আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, সদস্যদের সামনে অডিট রিপোর্ট উত্থাপন করবেন বেসিস সভাপতি। ইসি ব্যাখ্যা দেবে এজিএমে। সদস্যরা এটি মানবেন কি মানবেন না, এজিএমে তা নির্ধারণ হবে। যেহেতু ইসির কয়েকজন সদস্যের আপত্তি রয়েছে, বিষয়টি নিয়ে আমার মন্তব্য না করাই সমীচীন।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (যুগ্মসচিব) ড. জিন্নাত রেহানা সারাবাংলাকে বলেন, মাঝপথে অডিট ফার্ম পরিবর্তন করতে হলে ইসি সদস্যদের অনুমোদন লাগবে। ইসির অনুমোদন নিয়েছে কি না, আমরা জানি না। কেউ অভিযোগ দিলে আমরা বিষয়টি নিয়ে শুনানি করব।

বেসিসের মত একটি স্বনামধন্য ট্রেড বডিতে আর্থিক অনিয়মের প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারের এই যুগ্মসচিব বলেন, কোনো ধরনের বড় আর্থিক অনিয়মের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এলে সেটি নিয়েও আমরা শুনানি করব। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করব। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেব।

অডিট ফার্ম পরিবর্তন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে বেসিসের তিন পরিচালক ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন সংগঠনটির সহসভাপতি (প্রশাসন) আবু দাউদ খান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অডিট ফার্ম পরিবর্তনের বিষয়টি আমাদের সভাপতি ভালো বলতে পারবেন।’ এ বিষয়ে বেসিস সভাপতির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে বেসিস সহসভাপতি (অর্থ) ফাহিম আহমেদকে একাধিকার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায়নি। সংগঠনটির সভাপতি রাসেল টি আহমেদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হলে সাড়া পাওয়া যায়নি।

বেসিসের অ্যাকাউন্ট শাখায় চুরি

এদিকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বেসিস কার্যালয়ের অ্যাকাউন্ট শাখায় চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বেসিসের অ্যাকাউন্ট শাখার দুটি ল্যাপটপ ও লকার থেকে দেড় লাখ টাকা চুরি হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসিসের একজন পরিচালক জানান, এ ঘটনাটিও ইসির কাউকে জানানো হয়নি। ল্যাপটপ দুটিতে বেসিসের সব হিসাব সংরক্ষিত ছিল। হিসাবে অনিয়ম থাকায় চুরির ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে বলে ধারণা তার।

চুরির ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বেসিস সচিব হাশিম আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে বেসিস কার্যালয়ে চুরি হয়েছে। ২২ ফেব্রুয়ারি অফিসে যাওয়ার পর ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশকে অবহিত করেছি। তেজগাঁও থানায় মামলা হয়েছে। তদন্ত চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গেছেন। তবে এখনো প্রতিবেদন দেননি।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

অডিট আপত্তি বেসিস বেসিস কার্যনির্বাহী কমিটি বেসিসের অডিট ফার্ম বেসিসের এজিএম বেসিসের লেনদেন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর