বাজার বেসামাল, সীমিত আয়ে পকেট সামলাতে নাভিশ্বাস
১২ মার্চ ২০২৪ ১০:২৫
রাজশাহী: নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন। বিশেষ করে রমজান মাস সামনে রেখে যেন বাজার আরও বেসামাল হয়ে পড়েছে। সিয়াম সাধনার এই মাসটি সংযমের হলেও ব্যবসায়ীদের কাছে যেন তা পরিণত হয়েছে মুনাফা ‘লুটে নেওয়া’র সুযোগে। মাছ-মাংস থেকে থেকে শুরু করে ডাল-ছোলা, ফলমূল, শাক-সবজি কিংবা লেবু-শসা— কিছুই বাদ পড়ছে না মুনাফালোভীদের কবল থেকে। তাতে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠে গেছে ক্রেতাদের। বিশেষ খরে সীমিত, নির্ধারিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাজার পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে দুঃসহ।
বরাবরের মতোই এবারও বেশ আগে থেকেই সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেই হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছিল, রমজানে যেন বাজার অস্থিতিশীল না হয়। তবে সেসব হুঁশিয়ারি কাজে আসেনি। রোজার মাস সামনে রেখেও ধারাবাহিকভাবেই বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই চিড়ে চ্যাপ্টা সীমিত আয়ের মানুষ এখন রমজানের বাড়তি খরচ নিয়ে আছেন ভীষণ দুশ্চিন্তায়।
রাজশাহীর বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রোজার মাস দেড়েক আগে থেকেই ছোলা, অ্যাংকর, মুগসহ সব ধরনের ডালের দাম বেড়েছে। খেজুরের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। চিনির বাজারও অস্থির। সয়াবিন তেলের দাম সামান্য কমলেও তা বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে অনেকটা বেড়ে গেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। দাম বাড়ার তালিকা থেকে বাদ পড়েনি চিড়ামুড়িও। আর রমজানে একটু বেশি চাহিদা থাকা বেগুন, শসা, লেবুর কথা বলাই বাহুল্য।
গত এক বছরের ব্যবধানে দ্রব্যমূল্যের তুলনা করলে দেখা যায়, কোনো কোনো পণ্যের খরচ বেড়ে দ্বিগুণ পর্যন্ত হয়েছে। ২০ থেকে ৩০ শতাংশের নিচে দাম বাড়েনি কোনো পণ্যেরই। এখনকার বাজারে যেমন ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। গত বছরের রোজায় এর দাম ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। অ্যাংকর ডাল এবার ৯০ টাকা ছুঁয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে কেনা গেছে ৭০ টাকায়। গত বছর রোজার আগে মসুর ডালের দাম সেভাবে না বাড়লেও এবার ছোলার সঙ্গে মসুর ও মুগ ডালের দামও বেড়েছে। গত বছর এ সময় ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হওয়া বড় দানার মসুর ডাল এবার ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে দেশি পেঁয়াজের দাম গত বছর এই সময়ে ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এবার তা ৮০ টাকার কমে মিলছে না। রোজায় মুখরোচক নানা খাবারে ব্যবহার হয় চিনি। সেই খোলা চিনির কেজি এখন ১৫০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১১০ টাকা। সাধারণ মানের খেজুর গত বছর ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি। এবার তা ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের কেজি গত বছর ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা ছিল। এবার তা বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। গত বছর আলুর কেজি ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়।
গতকাল সোমবার (১১ মার্চ) বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে এখন এক কেজি সাধারণ মানের জিহাদি খেজুরের দাম ৩০০ টাকা। গত বছর রোজায় এ খেজুরের দাম ছিল ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। এ ছাড়া ভালো মানের খেজুরের কেজি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত, যা গত রমজানের থেকে কেজিতে ৫০০ টাকা বেশি।
রমজানের সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন পণ্য ছোলা সোমবার সকালে বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা কেজি দরে। পরে দুপুরে তা ১২০ টাকা ও বিকেলে ১৩০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হতে দেখা গেছে। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে ছোলার জন্য। একইভাবে পেঁয়াজু তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় খেসারি ডালের কেজি এখন বিক্রি ১৩০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৮০ টাকা। আবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আদা ২০০ টাকা, চায়না রসুন ২০০ টাকা ও দেশি রসুন ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত রমজানের তুলনায় কেজিতে প্রায় ১০০ টাকা করে বেড়েছে এসব পণ্যের দাম।
বাজারের এ পরিস্থিতিতে ঘাম ছুটে গেছে সাধারণ মানুষের। গত এক বছরের ধারাবাহিকতার ধাক্কা তো আছেই, রমজান মাস সামনে রেখে আরও এক দফা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের দুর্দশা কেবল বাড়িয়েইছে।
নগরীর বহরমপুর এলাকার সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, সীমিত বেতনের টাকায় মাসের বাজার খরচ সামলাতেই ঘাম ছুটে যায়। সেখানে রোজা সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়েছে। রমজানে কীভাবে বাজার খরচ সামাল দেবো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
অটোরিকশাচালক কাশেম আলী বলেন, রোজাকে ঘিরে যে হারে দাম বেড়েছে, মনে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের উৎসব লেগেছে! কিন্তু তাতে তো আমাদের মতো নিম্নআয়ের মানুষের পকেটে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। রোজায় যে কী হবে, জানি না।
সাহেববাজারের মুদি দোকানি লুৎফর রহমান বলেন, রোজায় কোনো পণ্যেই সুখবর নেই। এবার রোজার অনেক আগেই থেকে ছোলা খেসারি ডালসহ অন্যান্য সব ডালের দাম চড়া। আমাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়েছে। তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে।
মুদি দোকানের পণ্যগুলোর মতো মাছ-মাংস আর শাক-সবজির বাজারের অবস্থাও একই। সোমবার প্রতি কেজি শিম ৬০ টাকা, শসা ৮০ টাকা, মুলা ৩০ টাকা, ঝিঙ্গে ৬০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা ও লাউ প্রতি পিস ৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আলু বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩৫ টাকায়। কাঁচামরিচের কেজি ছিল ১০০ টাকা।
বাজারে দুই দিনের ব্যবধানে বেড়েছে মুরগির দাম। শুক্রবার ব্রয়লার ২০০ টাকা, সোনালি ২৯০ টাকা ও দেশি মুরগী ৪৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সোমবার সব ধরনের মুরগির দামই কেজিতে বেড়েছে অন্তত ২০ টাকা। গরুর মাংসের কেজিও বেড়ে হয়েছে ৭৫০ টাকা, খাসির মাংস ১১০০ টাকা।
বাড়তি যাচ্ছে মাছের দামও। পাঙাশ মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়, তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৪০ টাকায়। এ ছাড়া চাষের শিং মাছ প্রতি কেজি ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা, রুই ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, চাষের কই ৩০০ টাকা, দেশি ছোট কই ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, পাবদা মানভেদে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, শোল মাছ একটু বড় সাইজের ৯০০ টাকা, চিংড়ি ৮০০ টাকা, কাতল ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, বোয়াল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ও ছোট আকারের টেংরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে সোমবারের বাজারে।
প্রতিবছর রমজান মাস ঘিরে এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে ‘দুঃখজনক‘ অভিহিত করছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান মাস উপলক্ষে নিত্যপণ্যের দামে ছাড় দেওয়া হয়। দাম কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। আর আমাদের এখানে সম্পূর্ণ উলটো চিত্র। আমাদের দেশে এ সময়ে ভোক্তার পকেট কাটার প্রতিযোগিতা চলে। বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে একে একে সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজারের যে চিত্র, তাতে সঙ্গত কারণেই রোজার বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে সাধারণ ভোক্তা।
ব্যবসায়ীদের ‘পোয়াবারো’ আর ক্রেতাদের হিমশিম দশার মধ্যেই রমজানে বাজার তদারকিতে নিয়মিত মাঠে থাকার কথা জানিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সংস্থাটির রাজশাহী বিভাগীয় অফিসের উপপরিচালক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, রমজানের সময় আমাদের মনিটরিং আরও জোরদার করা হবে। বিশেষ অভিযানও চালানো হবে। কেউ কোনো সুযোগে যেন কোনো পণ্যের দাম না বাড়াতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।
সারাবাংলা/টিআর
ক্যাব দাম বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্য নিত্যপণ্য নিত্যপণ্যের বাজার বাজার বাজার পরিস্থিতি ভোক্তা অধিকার রাজশাহী