ছেলেকে সুস্থ ফিরিয়ে দিন— জিম্মি নাবিকের মায়ের আর্তি
১৩ মার্চ ২০২৪ ০০:০১
চট্টগ্রাম ব্যুরো : ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের বাসা চট্টগ্রাম নগরীতে। আকস্মিকভাবে প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির এমন বিপদের মুখে পড়া নিয়ে দিশেহারা পরিবারটির সদস্য ও স্বজনরা।
আতিকুল্লাহ’র পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মিনা আজমাইন স্বামীর এমন বিপদের কথা শুনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যায় তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধা মা আতিকুল্লাহ’র তিন মেয়েকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন।
এদিন রাত ১০টার দিকে নগরীর নন্দনকাননের রথেরপুকুর পাড় এলাকায় আতিকুল্লাহ খানের বাসায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। উদ্বেগ-আশঙ্কা নিয়ে স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরাও ছুটে আসছেন ওই বাসায়। কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছেন পরিবারটির সদস্যদের।
আতিকুল্লাহ’র মা শাহনূর আক্তার সারাবাংলাকে জানান, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আতিকুল্লাহ তার স্ত্রীকে হোয়াটস অ্যাপে ফোন করে তাদের জলদস্যুর হাতে জিম্মি হওয়ার খবর জানান। এরপর সন্ধ্যার দিকে ফের ফোন করে জানান, জিম্মি সব নাবিকের মোবাইল ফোন জলদস্যুরা কেড়ে নিচ্ছে।
আরও পড়ুন: ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে বাংলাদেশি জাহাজ
শাহনূর আক্তার বলেন, ‘আমার বৌমাকে ফোন করে বলল, জলদস্যুরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা জাহাজে উঠে আমাদের ঘিরে রেখেছে। তবে আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি। ২০ মিনিট পর আবার ফোন করে বলল, আমাদের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিচ্ছে। এখন আমার মোবাইলও কেড়ে নেবে। আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ হবে না। আমাদের সোমালিয়া নিয়ে যাচ্ছে। আড়াইদিন লাগবে আমাদের সোমালিয়া পৌঁছতে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাহনূর বলেন, ‘আমি আমার ছেলেটাকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত চাই। তার তিনটা ছোট ছোট মেয়ে। বৌ অন্তঃসত্ত্বা। শোনার পর থেকে বৌ খালি কান্না করছে। তার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। তাকে এখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। হয়তো হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আমার নাতনিরা পাঁচ মিনিট পর পর এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার ছেলেকে দ্রুত সুস্থ অবস্থায় আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি দেশবাসীর কাছে আমি দোয়া চাই।’
আতিকুল্লাহদের বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরকল ইউনিয়নে। তার বাবা বেঁচে নেই। দুই ভাইয়ের মধ্যেই তিনিই বড়। আরেকভাই এখনও পড়ালেখায় আছেন। তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ইয়াশা ফাতিমা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। মেঝ মেয়ে উমাইজা মাহাবিন প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে খাদিজা মাহাবিনের বয়স মাত্র দুই বছর।
ইয়াশা ফাতিমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে একবার পাপ্পা যখন ফোন করেছিল, তখন আমার আম্মু রিসিভ করে কথা বলেন। মাগরিবের নামাজের পর ফের যখন ফোন করে, তখন উমাইজা রিসিভ করে আম্মুকে দেয়। তখনই পাপ্পার সঙ্গে আমাদের লাস্ট কথা হয়েছে। পাপ্পা বলেছে, উনাদের সবাই মোবাইল নাকি নিয়ে নিচ্ছে। আমি চাই, আমার পাপ্পা সুস্থভাবে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক।’
শাহনূর জানান, তিন মাস আগে আতিকুল্লাহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে যোগ দেন। এর ১৫-২০ দিন পর একবার জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিলেন। তখন একবার বাসায় এসেছিলেন। সে-ই ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা।
জিম্মি অবস্থায় থাকা আতিকুল্লাহ’র সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে কথা হয়েছে বন্ধু জুলকার নাঈমের সঙ্গেও। এরপর তিনি ওই বাসায় ছুটে আসেন।
জুলকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ফেসবুকে ঘটনাটি জানতে পেরে আমি তাকে হোয়াটস অ্যাপে নক দিই। সে কল করার পর জিজ্ঞেস করলাম- ঘটনা কী? আতিক বলল- ৫০ জন জলদস্যু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের জিম্মি করে ফেলেছে। ওরা ক্যাপ্টেন এবং অন্যান্য নাবিকদের সঙ্গে কথা বলছে। সম্ভবত নেগোসিয়েশনের কথা বলছে। সবাই আমার জন্য দোয়া করিস। তখন বলেছে, তাদের নাকি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর আর কথা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার ভাই এখনও ছোট। পরিবারে আয়-উপার্জন করার মতো আর কেউ নেই। বাবাও মারা গেছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে সুস্থ অবস্থায় যেন ফেরত এনে দেওয়া হয়, সেটাই আমাদের চাওয়া।’
এমভি আবদুল্লাহ নামে জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বেলা ১২টার দিকে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়।
এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ মেহেরুল করিম সারাবাংলাকে জানান, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে জাহাজটি সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাই যাচ্ছিল। জাহাজে থাকা নাবিকদের কাছ থেকে তারা জলদস্যু আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানতে পারেন।
কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সন্ধ্যায় আমাদের সঙ্গে জাহাজের নাবিকদের সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে। তারা সবাই অক্ষত আছেন। তাদের সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্ম শ্মসুদ্দিন, মো . আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরবসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
আতিকুল্লাহ খান এমভি আবদুল্লাহ চিফ অফিসার জলদস্যু জিম্মি সোমালিয়া