Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি— তবু কমছে না তামাক চাষ

রাব্বি হাসান সবুজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৩ মার্চ ২০২৪ ০৮:০০

রংপুর এলাকায় বিস্তীর্ণ জমিতে চাষ হয়েছে তামাক। ছবি: সারাবাংলা

রংপুর: নীরব ঘাতক তামাক চাষাবাদ থেকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের। সরকারের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হলেও অন্য ফসলের চেয়ে তামাকের উৎপাদন ও দাম বেশি পাওয়ায় বরং তারা আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছেন তামাক চাষে। এর সঙ্গে বিভিন্ন তামাক কোম্পানির প্রলোভন তো আছেই।

এ অবস্থায় চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে তুলছে দিন দিন। তবে তামাকের পরিবর্তে গম ও ভুট্টা চাষ বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্প চালু করা হলেও তা কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গবেষকরা বলছেন, কৃষকদের এখনই তামাকচাষে নিরুৎসাহিত করতে না পারলে পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মাটির গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

একসময় আলু, ভুট্টা, গমসহ অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি তামাক চাষ করতেন রংপুরের হারাগাছ এলাকার আসলাম মিয়া। তবে এখন তামাক চাষ ছাড়া অন্য কোনো ফসল আর উৎপাদন করেন না। কারণ হিসেবে জানালেন, তামাক কোম্পানিগুলো তামাক চাষে নানা ধরনের সহায়তা করছে। সে কারণেই স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মাটির ক্ষতি জেনেও তামাক চাষ করছেন।

আসলাম মিয়া বলেন, আমার মতো বেশিরভাগ কৃষকই এবার আলুর জমিতে তামাক চাষ করেছেন। অন্যান্য ফসল চাষে বীজ, সার, সেচসহ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তার ওপর ফসল উৎপাদন করে সঠিক দাম পাওয়া যায় না। মাঠ থেকে বাজার পর্যন্ত ফসল নিয়ে যেতে যে খরচ, উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ করলে বিক্রির পর হাতে কিছুই থাকে না। কিন্তু তামাক চাষ করলে সিগারেটের কোম্পানিগুলো আগাম লোন দেয়, তাও সুদ ছাড়া। দাম নিয়েও চিন্তা করা লাগে না।

কৃষকরা বলছেন, আবাদে লোকসানের আশঙ্কা নেই, বরং লাভ বেশি বলেই তামাক চাষ করছেন তারা। ছবি: সারাবাংলা

আর্থিকভাবে লাভবান হলেও আসলাম মিয়ার পরিবারের প্রায় সবাই অসুস্থ বলে জানালেন তিনি। তার ভাষ্য, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, অ্যাজমা ও ফুসফুসজনিত রোগে ভুগছেন তিনিসহ পরিবারের সদস্যরা। এর পেছনে তামাক চাষের ভূমিকা থাকতে পারে— তেমন ধারণা তারও রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের কৃষক মিজানুর রহমান গত বছর পাঁচ বিঘা জমিতে আলু লাগিয়েছিলেন। নায্য মূল্য না পেয়ে এবার তিনি একই জমিতে তামাক চাষ করেছেন। অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই মিজানুর বলেন, আলুর বীজের যে দাম, সঙ্গে সার কীটনাশকও আছে। সব মিলিয়ে অনেক খরচ। আবার অন্যান্য ফসল বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। কিন্তু তামাক বছরের পর বছর সংরক্ষণ যায়। তাই তাই কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে তামাক লাগিয়েছি। এখন আর লোকসানের চিন্তা নাই।

আসলাম মিয়া ও মিজানুর রহমানের মতো হাজার হাজার কৃষক রংপুর অঞ্চলে এবার তামাক চাষ করেছেন। এ বছর রংপুর কৃষি অঞ্চলে তামাকের আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমিতে, গত বছর যা ছিল ১০ হাজার ৮২০ হেক্টর। সে হিসাবে প্রায় গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে তামাকের আবাদ।

কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, এ অঞ্চলে উৎপাদিত মোট তামাকের ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয় লালমনিরহাট জেলায়। এর পরের অবস্থান রংপুর ও নীলফামারীর। রংপুরের মমিনপুরের পাশাপাশি লালমনিরহাটের সারপুকুর, সাপ্টিবাড়ী, ভাদাই, দূর্গাপুর ও কাকিনাকে বলা হয় তামাকের ইউনিয়ন।

নীরব ঘাতক তামাক চাষাবাদ থেকে কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আর্থিক সুবিধা পেলেও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন। তারপরও কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তামাকের আগ্রাসন। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারে সরাসরি যুক্ত। একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রসহ জনসমাগমস্থল ও গণপরিবহণে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন আরও তিন কোটি ৮৪ লাখ মানুষ। গবেষণায় দেখা যায়, তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা।

তামাক পাতার স্তূপ। এই তামাক আবাদের জন্য তামাক কোম্পানিগুলো আগাম ঋণও দেয় কৃষকদের। ছবি: সারাবাংলা

তামাক আবাদ নিরুৎসাহিত করতে সরকার কী করছে— জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল সারাবাংলাকে বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে উঠান বৈঠক, সচেতনতা সভা করা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন তামাকজাত কোম্পানিগুলোর প্রলোভন ও নানা সুবিধার কারণে এসব এলাকায় কৃষকেরা তামাক চাষ করছেন।

ওবায়দুর রহমান জানালেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে সরকার। পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সহাহতায় এই প্রকল্পটি এবার তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ চরে পরীক্ষামূলকভাবে তামাকের পরিবর্তে গম ও ভুট্টা চাষ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাক্কলন অনুযায়ী ফলন মিললে এই প্রকল্পের আওতায় থাকা কৃষকরা আর্থিকভাবে কয়েক গুণ বেশি লাভবান হবেন। পাশাপাশি তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও রক্ষা পাবে পরিবেশ ও প্রতিবেশ।

সম্প্রতি বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন রংপুরের গঙ্গাচড়ার চরাঞ্চল পরিদর্শনে করেন। তিনি বলেন, আমরা কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে এবার গম ও ভুট্টা চাষে উৎসাহ দিচ্ছি। আপাতত তিস্তার ৪০০ কৃষককে সার, বীজ, সেচ সুবিধাসহ প্রশিক্ষণ ও কৃষিঋণ দেওয়া হয়েছে। ১০০ একর জমিতে তামাক বাদ দিয়ে চাষ করা হয়েছে গম ও ভুট্টা। আশা করি ছোট ছোট কৃষিঋণের মাধ্যমে আমরা আরও কৃষককে এ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে পারব।

মাঠ পরিদর্শনে আসা প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের। তিনি বলেন, আরডিএর মাধ্যমে কৃষকদের তামাকের পরিবর্তে গম ও ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পরীক্ষামূলকভাবে যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে তা সফল হলে আমাদের কৃষকদের যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাড়বে, তেমনি গম ও ভুট্টার ফলন বাড়ানো গেলে আমাদের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে।

বর্তমানে চলমান উদ্যোগ ছাড়াও এর আগে রংপুর অঞ্চলে তামাক আবাদ কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সেগুলো খুব একটা কাজে আসেনি। এখন তামাক আবাদ বাড়তে থাকায় একদিকে প্রধান প্রধান শস্য আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিজমি কমছে, অন্যদিকে তামাক আবাদ করা কৃষিজমির উর্বরতাও নষ্ট হচ্ছে। এর সঙ্গে কৃষকসহ সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো রয়েছেই।

রাস্তার দুপাশেই শুকানো হচ্ছে তামাক পাতা। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ছবি: সারাবাংলা

এ প্রেক্ষাপটে কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে বড় উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান রিপন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় ২০৪০ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ থেকে তামাক শতভাগ নির্মূল করার অঙ্গীকার আছে। কৃষিকে সত্যিকার অর্থে বাণ্যিজ্যিক কৃষি, আধুনিক কৃষি করা গেলে ২০৪০ সালের আগেই তামাকমুক্ত সমাজ গড়া যাবে। এরই মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্র অর্জন সম্ভব হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান রিপন আরও বলেন, তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো থেকে প্রতি বছর সরকারের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের জন্য। অর্থাৎ লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যাযমূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি কৃষির আধুনিকায়ন, যান্ত্রিকিকরণ ও রফতানি বাজার প্রসারিত করলেই তামাক চাষে নিরুৎসাহিত হবে কৃষক।

তামাক চাষের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ আলী বলেন, তামাক চাষের প্রক্রিয়ার যারা সরাসরি যুক্ত তারা তো বটেই, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও কান-নাক-গলা এবং মুখ ও ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বাড়তি লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষ করছেন। এখানে আমাদের খুব বেশি কিছু করার নেই।

সারাবাংলা/টিআর

ক্যানসারের ঝুঁকি তামাক আবাদ তামাক কোম্পানি তামাক চাষ তামাক চাষে স্বাস্থ্যঝুঁকি তামাকের আগ্রাসন স্বাস্থ্যঝুঁকি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর