জিম্মি জাহাজ সোমালিয়া উপকূলে, নাবিকরা অক্ষত আছেন
১৪ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজটিকে সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাহাজটির মালিকপক্ষ জানিয়েছে, বুধবার (১৩ মার্চ) রাতে এক নাবিকের পাঠানো সর্বশেষ অডিওবার্তায় তারা সবাই অক্ষত এবং সুস্থ আছেন বলে জানা গেছে। জাহাজ জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে পৌঁছানোর পর এখন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করবে মালিকপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুর ১টায় বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) জানিয়েছে, জলদস্যু নিয়ন্ত্রিত জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল গারাকাদ বন্দর থেকে আনুমানিক ২০ মাইল দূরে নোঙ্গর করেছে। পুরো অঞ্চলটি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণাধীন।
বিএমএমওএ’র সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘন্টায় ৯ নটিক্যাল বেগে সাগর অতিক্রম করে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছেছে। আমরা যতদূর জানি, এখনও জলদস্যুদের পক্ষ থেকে তাদের কোনো প্রতিনিধি জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তাদের কাছ থেকে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া পেতে হয়তো আরও ২-৩ দিন সময় লাগতে পারে।’
জলদস্যুদের কবলে পড়া ‘এমভি আবদুল্লাহ’ নামে জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন।
কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুর নাগাদ জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে গারাকাদ বন্দরের অদূরে জলদস্যুদের ‘সেইফ জোনে’ নোঙ্গর করেছে।
এদিকে জাহাজে জিম্মি এক নাবিক বুধবার রাত ১১টার দিকে তার পরিবার এবং মালিকপক্ষের কাছে অডিওবার্তা পাঠিয়ে তাদের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছে।
মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নাবিকের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করছি না। তবে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, নাবিকরা সবাই অক্ষত আছেন। জলদস্যুরা তাদের ওপর শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো ধরনের চাপ এখনও পর্যন্ত প্রয়োগ করছে না। তবে যেহেতু তারা অনেকটা জিম্মি অবস্থায় আছেন, স্বাভাবিকভাবে মানসিক চাপ তো আছেই।’
‘আমরা জেনেছি যে, নাবিকরা সবাই স্বাভাবিকভাবেই রোজা রাখতে পারছেন। তাদের সেহেরি এবং ইফতারে পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। জাহাজেই ২০-২৫ দিনের খাবার ও ২০০ টন পানি মজুত আছে। সেগুলো জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নাবিকদের খাবার-পানি ব্যবহারে কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হচ্ছে না।’
জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে তিনটা পক্ষ আছে। আমরা একটা পক্ষ, আমাদের সঙ্গে দেশের সরকার আছে। আরেকটি পক্ষ বীমা প্রতিষ্ঠান এবং জলদস্যুদের প্রতিনিধি হিসেবে তৃতীয় পক্ষ। আমাদের সঙ্গে মূলত যোগাযোগ হবে তৃতীয় পক্ষের। আগেও আমাদের একটি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। তখন দেখেছি, জলদস্যুরা জাহাজ সেইফ জোনে না নেওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। এবারও সেইফ জোনে নেওয়ার পর তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হতে পারে বলে ধারণা করছি।’
এরপরও মালিকপক্ষে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত আছে জানিয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু তাদের থার্ড পার্টির সন্ধান তো আমাদের পেতে হবে। আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। সরকারিভাবে এ বিষয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে দাফতরিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
নাবিকদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে অক্ষত অবস্থায় ফেরত আনার বিষয়ে কেএসআরএম’র অবস্থান অটুট আছে বলে তিনি জানান।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টার দিকে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জলদস্যুরা জাহাজের নাবিকদের জিম্মি করেছে। মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে জাহাজের নাবিকরা তাদের স্বজন ও মালিকপক্ষের কাছে অডিওবার্তা পাঠান। এতে জিম্মি করা হলেও তাদের কোনো ধরনের নির্যাতন করা হচ্ছে না বলে নাবিকরা জানান। অবশ্য এক নাবিকের স্বজন বলেছেন, টাকা না দিলে জলদস্যুরা একে একে নাবিকদের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।
জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চীফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চীফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্ম শ্মসুদ্দিন, মো . আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
বিএমএমওএ জানিয়েছে, জিম্মি নাবিকদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের ও ২ জন নোয়াখালীর। বাকি ১০ জন যথাক্রমে ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, খুলনা, নেত্রকোনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল জেলার।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে জাহাজটি সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাইয়ের আল-হামরিয়া বন্দরে যাচ্ছিল। ১৯ মার্চ গ্রিনিচ সময় রাত ৮টায় জাহাজটি সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা ছিল।
কেএসআরএম গ্রুপের মোট ২৩টি জাহাজ আছে, যেগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করছে। গোল্ডেন হক নামে পরিচিত এমভি আবদুল্লাহ গত বছর কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানায় আসে।
এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের উপকূলে আরবসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
সারাবাংলা/আরডি/ইআ