৫৫ বছরের এক মহাজীবনের ১০৫তম জন্মদিন আজ
১৭ মার্চ ২০২৪ ০০:০৩
ঢাকা: মাত্র ৫৫ বছরের এক মহাজীবন। সেই জীবনের লক্ষ্যই ছিল মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা। তাই জীবন কেটেছে রাজপথে। কিন্তু শোষকগোষ্ঠী সেই মুক্তির সংগ্রামকে মেনে নিতে পারেনি। তাই বার বার তাকে গ্রেফতার করে ধরে নিয়ে গেছে কারাগারে। তার ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় ১৩ বছরই কেটেছে কারাগারে। তাতেও দমে যাননি তিনি। নিজের অবিচল লক্ষ্য থেকে পিছু হটেননি একচুল। আর তাই তো মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল করে তুলে জাতিকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতার ও মুক্তির স্বাদ।
তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট খোকা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলার আপামর জনসাধারণের মুজিব ভাই। সেই শেখ মুজিবের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী রোববার (১৭ মার্চ)। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা। তার জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষ্যে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বনেতায় পরিণত হওয়া এই মহান নেতার এই জন্মদিবসে জাতি আজ শ্রদ্ধাবনত। জাতির পিতার জন্মদিন উপলক্ষে এই দিনটিকে জাতীয় শিশু কিশোর দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯২০ সালে টুঙ্গীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’। সেই ‘খোকা’ই কালক্রমে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ ও জনগণের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের কারণেই পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির একমেবাদ্বিতীয়ম নেতা।
শেখ মুজিব সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন কিশোর বয়সেই। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশকে ভালোবেসে ভূষিত হন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। হয়ে ওঠেন মুক্তির মহানায়ক। বাঙালিকে এনে দেন স্বপ্নের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে যোগ দেন সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে নির্বাচিত হন তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম-সম্পাদক। পরে ১৯৫৩ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও পরবর্তী সময়ে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় লাভ করেন বঙ্গবন্ধু উপাধি। তার দূরদর্শী নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এমন সময় একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ডাক দেন স্বাধীনতার সংগ্রামের। সেই বজ্রকণ্ঠের আওয়াজ বাংলার মানুষের মনে স্বাধীনতার দামামা বাজিয়ে তোলে। পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীও টের পায়, এই জাতিকে আর ‘দাবায়ে রাখতে পারবে না’।
এমন পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই তাই বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার নেতৃত্বেই বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় গৌরবের স্বাধীনতা।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভরশীল একটি জাতি হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামও শুরু করেছিলেন জাতির পিতা। কিন্তু এর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে পড়ে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় পিতার শরীর। সেই কালরাত কেড়ে নেয় স্ত্রী-সন্তানসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সব সদস্যের জীবন। কেবল দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আজ পিতার আদর্শ সামনে রেখেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বাংলাদেশকে, সোনার বাংলার পথে।
রাজনীতির মহান কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। শিশু-কিশোরদের প্রতি তার বাৎসল্য ছিল অপরিসীম। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে শিশুদের ছিল অবাধ বিচরণ। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব তারাই দেবে। বঙ্গবন্ধু কোনো শিশুদের সমাবেশে গেলে বা শিশুরা বঙ্গভবনে তার সংস্পর্শে আসলে তিনি তাদের সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যেতেন।
এ কারণেই তার জন্মদিনটিকে ১৯৯৭ সালে ঘোষণা করা হয় জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে। ২০০১ সালে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হয়নি। পরে আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠনের পর থেকে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে।
দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আওয়ামী লীগ দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দলের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— রোববার (১৭ মার্চ) সকাল সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারা দেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন।
এদিন টুঙ্গিপাড়ায় সকাল সাড়ে ১০টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটির নেতারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং শিশু সমাবেশে অংশ নেবেন।
এ ছাড়া, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচি পালন করা হবে। এর অংশ হিসেবে বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, সন্ধ্যা ৬টায় মিরপুর ব্যাপিস্ট চার্চে খ্রিস্টান সম্প্রদায়, সকাল ১০টায় সবুজবাগ ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার এবং সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডাস্থ আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছে।
পরদিন সোমবার (১৮ মার্চ) সকাল ১১টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ভবনে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে সারা দেশে যথাযথ মর্যাদায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপনের জন্য দল এবং দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম