কে বড়— চবিতে বেণু বনাম সেকান্দরের লড়াই!
১৮ মার্চ ২০২৪ ২২:৩৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই উপ-উপাচার্যের (প্রো-ভিসি) ক্রমতালিকা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে সদ্য নিয়োগ পাওয়া অধ্যাপক মো. সেকান্দর চৌধুরী এবং তিন বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসা অধ্যাপক বেণু কুমার দে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। বিরোধ মেটাতে বিষয়টি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট থেকে গড়াচ্ছে রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক বেণু কুমার দে ২০২১ সালের ৬ মে পরবর্তী চার বছরের জন্য প্রো-ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি অ্যাকাডেমিক অর্থাৎ শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বে আছেন। চলতি বছরের ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মো. সেকান্দর চৌধুরী পবরর্তী চার বছরের জন্য উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) হিসেবে নিয়োগ পান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো দু’জন উপ-উপাচার্য দায়িত্ব পেয়েছেন। এর আগে কখনোই এ প্রতিষ্ঠানে এমন নজির নেই। দু’জন উপ-উপাচার্য একসঙ্গে দায়িত্বরত থাকায় ক্রম নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাকি তিনটি হচ্ছে- ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাদেশের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য উপযুক্ত এক বা একাধিক ব্যক্তিকে উপ-উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারেন। কিন্তু একাধিক উপ-উপাচার্য নিয়োগ পেলে ক্রম নির্ধারণ কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আইনে কিছু উল্লেখ নেই।
চবি সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য ও শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত প্রশাসনের দায়িত্বে যে উপ-উপাচার্য থাকেন, তাকেই জ্যেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনি আগে নিয়োগ পান তাকেই ক্রমতালিকায় শীর্ষে ধরা হয়।
জানা গেছে, সেকান্দর চৌধুরী উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর চবি উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহীর অনুসরণে ক্রম নির্ধারণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেকান্দর চৌধুরীকে ক্রমতালিকার দুই নম্বরে স্থান দেওয়া হয়। এতে মৌখিকভাবে আপত্তি তোলেন তিনি। তার দাবি, যেহেতু তিনি প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে তাকে ক্রমতালিকার প্রথমে বিবেচনা করতে হবে।
তবে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপে অধ্যাপক সেকান্দর চৌধুরী নিজে কোনো আপত্তি তোলেননি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো অভিযোগ করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে নয়শ শিক্ষক আছেন। তাদের কেউ অভিযোগটা তুলেছেন, এবং এর ফলে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আপনারা খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি হিসেবে যিনি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দায়িত্ব পালন করেন, তিনিই কিন্তু এক নম্বরে থাকেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এ সিস্টেমটাই ফলো করা হয়। সুতরাং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।’
এদিকে, সেকান্দর চৌধুরীর মৌখিক আপত্তির পর বেনু কুমার দে-ও তাকে ক্রমতালিকার দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আপত্তির কথা উপাচার্যকে জানান। তার দাবি, বয়স ও চাকরির মেয়াদ এবং প্রো-ভিসি হিসেবে নিয়োগকাল বিবেচনায় নিয়ে যেন ক্রম নির্ধারণ করা হয়।
জানতে চাইলে অধ্যাপক বেনু কুমার দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা একটা সমস্যা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অ্যাক্ট আছে, সেখানে সিরিয়ালটা নির্ধারণ করা নেই। তবে সার্ভিস রুল অনুযায়ী যিনি আগে নিয়োগ পাবেন তিনিই সিনিয়র হিসেবে বিবেচিত হবেন। কিন্তু নতুন প্রো-ভিসি বলেছেন, যেহেতু তিনি প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন, সুতরাং তিনিই সিনিয়র। মূলত এটা নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়েছে।’
ক্রমতালিকা নিয়ে দুই প্রো-ভিসির অবস্থান ‘মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্বে’ রূপ নেওয়ায় বিব্রত উপাচার্য শিরীণ আখতার। তিনি জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ পরিষদ সিন্ডিকেটের ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি মিটিং’ আহ্বান করেন। গত ১২ মার্চ এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে উপ-উপাচার্যদের ক্রম নির্ধারণ ছয় নম্বর এজেন্ডা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
জানা গেছে, দু’জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের ক্রম নির্ধারণ নিয়ে এমন অবস্থাতে বিব্রত হওয়ার কথা জানান সভায় উপস্থিত সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য। এ ধরনের সভা অপ্রত্যাশিত ও বিব্রতকর উল্লেখ করে তারা বিষয়টি উপাচার্য নিজেই সমাধান করতে পারতেন বলে সভায় মত দেন। এ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের মতামত চাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সভা শেষ হয়।
জানতে চাইলে সিন্ডিকেট সদস্য চবির অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নঈম হাসান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সভায় ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করা হয়েছে। সেখানে প্রো-ভিসি নিয়োগের বিষয় উল্লেখ আছে। তবে একাধিক প্রো-ভিসি নিয়োগ দেওয়া হলে ক্রম কী হবে সেটার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সংবিধি আছে সেগুলো আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করেছি। সেখানেও কিছু উল্লেখ নেই।’
এ অবস্থায় সিন্ডিকেট চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের মতামত চাওয়ার জন্য উপাচার্যকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান নঈম হাসান চৌধুরী।
জানা গেছে, সিন্ডিকেট কোনো সিদ্ধান্ত দিতে না পারায় উপাচার্য শিরীণ আখতার চবি প্রশাসনকে এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেন। সংশ্লিষ্টদের কাছে এটি ‘আপদকালীন’ ক্রমতালিকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে অ্যাকাডেমিক অর্থাৎ শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো কর্মসূচির আয়োজন হলে সেখানে প্রো-ভিসি (অ্যাকাডেমি) বেণু কুমার দে ক্রমতালিকার এক নম্বরে থাকবেন। আর প্রশাসনিক কোনো কর্মসূচি হলে সেকান্দর চৌধুরী এক নম্বরে থাকবেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারকে মোবাইলে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রো-ভিসি ক্রম তালিকার বিষয়টি সিন্ডিকেট অ্যাটর্নি জেনারেলের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভিসি ম্যাডাম দ্রুততার সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে মতামত জানতে চাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে বলেছেন। এ ব্যাপারে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই মতামত না পাওয়া পর্যন্ত দু’জন প্রো-ভিসি মহোদয়ের একজন অ্যাকাডেমিক বিষয়ে তালিকার এক নম্বরে থাকবেন, অপরজন প্রশাসনিক বিষয়ে এক নম্বরে থাকবেন। ভিসি ম্যাডাম এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।’
প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক বেনু কুমার দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আইন মেনে চলব। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস যে মতামত দেবে, সেভাবেই হবে।’
আর প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সেকান্দর চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি নিয়ে সিন্ডিকেট সভা হয়েছে এবং সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। দেখা যাক কী মতামত আসে !’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রো ভিসি বেণু কুমার দে সেকান্দর চৌধুরী