Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মধ্যপ্রাচ্যের বাজার মাতাচ্ছে মোর্শেদার হাতে তৈরি টুপি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২১ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৫

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পাতিলাপুর গ্রামে নারীদের হাতে তৈরি এসব টুপিই রফতানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। ছবি: সারাবাংলা

কুড়িগ্রাম: মোর্শেদা বেগমের যখন বিয়ে হয় তখন তিনি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সংসারে অভাব ছিল। কয়েক বছর পর সেই অভাবের তাড়নায় ১৯৯৫ সালে স্বামী জাবেদ আলীকে নিয়ে চলে যান টাঙ্গাইলে। কাজ নেন একটি টাওয়াল কারখানায়। তারা যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, তার পাশের বাসাতেই থাকতেন কমলা বেগম। তিনি হাতে টুপি তৈরি করতেন। তা দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন মোর্শেদা। কমলা বেগমের কাছ থেকে শিখে নেন টুপি তৈরির কলাকৌশল। দিনে কারখানায় কাজ করা শেষ করে রাতে মনোযোগ দেন টুপি তৈরিতে।

সেই টুপিই ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে মোর্শেদার। প্রায় তিন দশক পর তার তৈরি টুপি এখন রীতিমতো মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে রফতানি হচ্ছে। সেখানকার চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। এখন নিজ এলাকা কুড়িগ্রামের উলিপুরে টুপি তৈরিতেই রীতিমতো হাজারও নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন তিনি।

উলিপুরের পাতিলাপুর গ্রামের বাড়িতে কথা হয় মোর্শেদার সঙ্গে। তিনি জানান, কমলা বেগমের কাছে টুপি তৈরি শিখে প্রথম টুপি তৈরি করে মজুরি পেয়েছিলেন ৩৫০ টাকা। পরে তার নিখুঁত কাজ দেখে মুগ্ধ হন এক বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা। ৫০টি টুপির অর্ডার দেন প্রতি পিস ৩৪০ টাকা হিসাবে ১৭ হাজার টাকায়।

ওই অর্ডারই মোর্শেদার ভাবনার জগত পালটে দেয়। ওই অর্ডারের টুপি সরবরাহ শেষে ফিরে আসেন গ্রামে। নিজেই পরিণত হন উদ্যোক্তায়। গড়ে তোলেন টুপি তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘নিপুণ হস্ত শিল্প সম্ভার’। নিয়োজিত করেন এলাকার সাত নারীকে। সময়ের পরিক্রমায় এখন তার সঙ্গে টুপি তৈরিতে কাজ করছেন প্রায় পাঁচ হাজার নারী। শুধু তাই নয়, আশপাশের গ্রামের নারীরাও মোর্শেদার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে টুপি তৈরিকেই নিজেদের কর্মসংস্থানে পরিণত করেছেন। সে কাজে যোগ দিয়েছেন পাতিলপুরসহ আশপাশের গ্রামের পুরুষরাও।

টুপি তৈরি করছেন নারীরা। দেখভাল করছেন মোর্শেদা বেগম। ছবি: সারাবাংলা

মোর্শেদা জানালেন, কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রাম উলিপুর উপজেলার পাতিলপুরের নারীদের হাতে তৈরি এসব টুপি মধ্যপ্রাচ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। বাহারি রঙের সুতা আর রেশমার (নকশা আঁকা কাপড়) ওপরে আঁকা বিভিন্ন নকশার টুপির চাহিদা বেড়েই চলছে। সেই চাহিদা মেটাতেই দিন দিন কর্মী সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে তাকে। আর সেটি করেই মোর্শেদা সফল। এলাকার বেকার নারীদের কর্মসংস্থান তৈরির আইকনেও পরিণত হয়েছেন তিনি।

নিপুণ হস্ত শিল্প সম্ভারের পরিচালক মোর্শেদা বলেন, ফেনীর দুজন ব্যবসায়ী আছেন। তারা আমাদের কাছে রেশমা (নকশা আঁকা কাপড়) সরবরাহ করেন। সেই রেশমার ওপর আমাদের এখানকার মেয়েরা সুঁই-সুতা দিয়ে বিভিন্ন নকশার টুপি তৈরি করেন। এই টুপিগুলো আবার ওই দুই ব্যবসায়ীর কাছেই আমরা বিক্রি করি। তাদের মাধ্যমে এসব টুপি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চলে যায়।

মোর্শেদা নিজেও এখনো সার্বক্ষণিক দেখভাল করেন টুপি তৈরির কাজ। পাশাপাশি ১৫ জন সুপারভাইজারও রেখেছেন। তিনি জানান, হাতে বানানো প্রতিটি টুপির জন্য প্রকারভেদে নারীরা পারিশ্রমিক পান ৮০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা। এর মধ্যে সুঁই-সুতার খরচ ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। প্রতি টুপিতে তিনি নিজে কমিশন পান ৭০ থেকে ৯০ টাকা। প্রতি মাসে টুপি বিক্রি করেন ৮ থেকে ১০ হাজার পিস। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নিপুণ হস্ত সম্ভারের পরিধি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে জানান তিনি।

মোরর্শেদার নিপুণ হস্ত শিল্প সম্ভারে কাজ করেন বিভিন্ন বয়সী মেয়ে ও নারীরা। স্কুলশিক্ষার্থীরাও পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে তার এখানে টুপি তৈরির কাজ করছে। পাতিলাপুর গ্রামের হাওয়া বেগম জানান, চার বছর আগে মোর্শেদার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে টুপি তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি টুপি তৈরি করেন। আর এর কল্যাণে এখন তার সংসারে আর কোনো অভাব নেই।

মোর্শেদা বেগমের গড়ে তোলা নিপুণ হস্ত শিল্প সম্ভারে টুপি তৈরিতে নিয়োজিত কয়েক হাজার নারী। ছবি: সারাবাংলা

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোছা. মুক্তা খাতুন বলল, পড়ালেখার পাশাপাশি আমি মোর্শেদা আন্টির এখানে টুপি তৈরির কাজ করি। এখান থেকে যা উপার্জন হয়, লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করতে পারি। শুধু আমি না, আমার মতো অনেক মেয়েই এখন টুপি তৈরি করে ভালো টাকা উপার্জন করতে পারছে।

সাত দরগাহ গ্রামের মৌসুমি বলেন, সারা বছরই আমরা টুপি তৈরির কাজ করি। বিশেষ করে রমজান মাস থেকে শুরু করে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত টুপির চাহিদা বেশি থাকে। এ সময়ে টুপি বানিয়ে একেকজন মাসে আট থেকে ১০ হাজার টাকা পাই। কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে খুব সুন্দর ঈদ কাটাতে পারছি।

কুড়িগ্রাম বিসিকের উপব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ জোনায়েদ বলেন, পাতিলাপুর গ্রামের নারী উদ্যোক্তা মোর্শেদা বেগম হাজার হাজার নারীর কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন। তার ওখানে তৈরি টুপি মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে— এটি কুড়িগ্রাম জেলার জন্য ভালো খবর। সরকারি কোনো প্রশিক্ষণ, আর্থিক ঋণ বা তৈরি টুপি বাজারজাত করার ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে কুড়িগ্রাম বিসিক অবশ্যই মোর্শেদা বেগমকে সহযোগিতা করবে।

সারাবাংলা/টিআর

কুড়িগ্রাম টুপি টুপি রফতানি নারী উদ্যোক্তা নিপুণ হস্ত শিল্প সম্ভার মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি মোর্শেদা বেগম হাতে তৈরি টুপি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর