ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে সেলা টানেল
২৩ মার্চ ২০২৪ ১৮:২৮
উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ে একটি সুড়ঙ্গ সড়ক নির্মাণ করেছে ভারত। সুড়ঙ্গ সড়কটি নিয়ে চীন ও ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত বিরোধ আবার উত্তেজনায় রূপ নিয়েছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেলা টানেল নামক সুড়ঙ্গ সড়কটির উদ্বোধন করেন। তিনি এই টানেলটিকে ভারতীয় প্রকৌশল কীর্তির একটি নজির হিসেবে প্রশংসা করেন। হিমালয়ের প্রায় ১৩ হাজার ফুট (৩৯০০ মিটার) উচ্চতায় এই টানেলটি নির্মাণ করা হয়েছে।
এটি একটি অল ওয়েদার অর্থাৎ সব ধরনের আবহাওয়ায় ব্যবহার উপযোগী সুড়ঙ্গ সড়ক। ফলে প্রকল্পটি বিরোধপূর্ণ সীমান্তে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জন্য একটি আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। টানেলের কারণে এখন সীমান্তে দ্রুত সেনা ও রশদ সরবরাহ করতে পারবে ভারতের সামরিক বাহিনী। চীনের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ এই সীমান্তে এমন সুবিধা ভারতের সামরিক বাহিনীর জন্য বড় সুযোগ।
এই বিষয়টি বেইজিংয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ভারতের সঙ্গে চীনের ২১০০ মাইল (৩৩৭৯ কিলোমিটার) সীমান্ত নিয়ে বিরোধ আছে। দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এ নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সশস্ত্র সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়েছে। ২০২০ সালে সীমান্তের বিস্তৃত পশ্চিমে আকসাই চিন-লাদাখ অঞ্চলে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি সংঘর্ষ হয়েছিল। সেই লড়াইয়ে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় এবং চারজন চীনা সেনা নিহত হয়। কয়েক দশক আগে এই সীমান্ত বিরোধে দেশ দুটি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ জড়িয়েছিল।
যেখানে টানেলটি তৈরি করা হয়েছে সেই এলাকা ভারতের অরুণাচল প্রদেশে পড়েছে। চীন এই অরুণাচল প্রদেশটিকে নিজেদের বলে দাবি করে থাকে। যদিও প্রদেশটি ভারতের সঙ্গেই রয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে চীনা কর্মকর্তারা টানেল প্রকল্প এবং মোদির অরুণাচল প্রদেশ সফরের নিন্দা করেছেন। সীমান্তে নয়াদিল্লি শান্তি নষ্ট করার পদক্ষেপ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা।
অরুণাচল প্রদেশের চীনা নাম ‘জাংনান’। এই প্রদেশটিকে চীনারা দক্ষিণ তিব্বতও বলে থাকে। চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র গত সপ্তাহে চীনা নাম জাংনান ব্যবহার করে বলেছিলেন, ‘সীমানা প্রশ্নকে জটিল করে তুলতে পারে এমন যেকোনো পদক্ষেপ ভারতীয় পক্ষকে বন্ধ করতে হবে। সীমান্ত প্রশ্নে চীনা সামরিক বাহিনী অত্যন্ত সজাগ থাকবে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করবে।’
গত মঙ্গলবার চীনের এসব প্রতিক্রিয়ার পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ভারত। বেইজিংয়ের ‘অযৌক্তিক’ দাবির নিন্দা করে ভারতের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ‘অঞ্চলটি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ছিল, আছে এবং থাকবে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরও বুধবার একটি সংবাদ সম্মেলনে অরুণাচল প্রদেশে ভারতের সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের সমালোচনা করে বলেছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বা ডি ফ্যাক্টো সীমানা পেরিয়ে অনুপ্রবেশ বা দখলের মাধ্যমে আঞ্চলিক দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার যেকোনো একতরফা প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই কথার পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে চীন। ওয়াশিংটনকে অন্য দেশের ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতকে উসকে দিয়ে স্বার্থপর ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের চেষ্টা না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে বেইজিং।
বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় টানেলের কারণে চীন-ভারতের সীমান্ত বিরোধ নতুন মাত্রা পেয়েছে। এশিয়ার বৃহত্তম দুটি দেশ আবার উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বিবাদটি এমন এক সময় আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যখন আর কয়েক সপ্তাহ পরেই ভারতে লোকসভা নির্বাচন। চীনের সঙ্গে এই উত্তেজনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্ল্যাটফর্মের জন্য আরও জোরদার সমর্থন আদায়ের একটি সুযোগ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
চীনে যেমন শি জিনপিং জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে একটি কঠোর বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে ক্ষমতা সুসংহত করেছেন—ভারতেও তেমনটাই করছেন নরেন্দ্র মোদি। ২০২০ সালের সংঘর্ষের পর অবশ্য উভয় দেশই সীমান্তে উত্তেজনা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে বলে দৃশ্যমান হয়েছে।
শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশী দেশ ভুটান সফর করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, ভারত-ভুটান সম্পর্ক দৃঢ় করার লক্ষ্যে তিনি এই সফর করছেন। অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত হিমালয় অঞ্চলের একটি দেশ ভুটান। চীনের সঙ্গে ভুটানেরও বিরোধপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে। তবে ভুটান ও চীনের নেতারা এই সীমান্ত বিরোধ মীমাংসা করতে চাচ্ছেন। চীন-ভুটানের সীমানা বিরোধ মীমাংসার বিষয়ে ভারত বেশ সতর্ক। নয়াদিল্লিকে পাশ কাটিয়ে চীন-ভুটানের সীমানা বিরোধ মীমাংসা হয়ে গেলে চাপে পড়বে ভারত। নরেন্দ্র মোদি এই উদ্বেগ থেকেই ভুটান সফর করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি মার্চের মাসের শুরুর দিকে অরুণাচল প্রদেশ সফরের সময় মোদি সেলা টানেলকে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময় হিসেবে প্রশংসিত করেছেন। একই সময় তিনি সীমান্তে আরও বেশ কয়েকটি অবকাঠামোসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন।
একসময় ভারত মনে করত, বিরোধপূর্ণ সীমান্তে এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন না করাই ভালো। ভারতের ধারণা ছিল, বিরোধপূর্ণ রুক্ষ সীমান্তে অবকাঠামো না থাকলে সম্ভাব্য চীনা আক্রমণে প্রতিবন্ধক প্রভাব ফেলবে। চীন সীমান্ত ভেদ করে ভারতে ঢুকে গেলে দ্রুত এগুতে পারবে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সরকার এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। মোদি সরকারের নীতি অনেকটাই চীনের মতো। এখন ভারতের নীতি হলো সীমান্তে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীর জন্য প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ বাড়ানো। সীমান্তে অবকাঠামো সুবিধা থাকলে সেনারা দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারবে এবং সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করতে পারবে।
বিরোধপূর্ণ সীমান্তের ভারতীয় অংশে ব্যাপক উন্নয়নের নীতি নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। এর অংশ হিসেবেই টানেলসহ এসব উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করা হচ্ছে। ভারতের এই অবকাঠামো উন্নয়নকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে চীন।
রাস্তা, সেতু এবং বিমানবন্দরের মতো অবকাঠামো নির্মাণের জন্য গত বছর ভারতের বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন ১১৮টি প্রকল্প হাতে নেয়। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রকল্প অরুণাচল প্রদেশ এবং লাদাখে। এই দুই অঞ্চলের সীমান্ত নিয়েই চীনের সঙ্গে বিরোধ আছে ভারতের।
এ ধরনের আগ্রাসী উন্নয়নের মাধ্যমে সীমানা প্রশ্নকে জটিল করা এবং দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত এলাকায় পরিস্থিতি ব্যাহত করার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে চীন।
কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত কয়েক দশক ধরে বিরোধপূর্ণ সীমান্তের চীন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মাণ করে আসছে চীন। কয়েক দশক ধরে চীনের রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মাণের পর একটি ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলা করছে ভারত। এখন অবকাঠামো নির্মাণ করায় সীমান্ত এলাকায় সেনা মোতায়েনের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি উল্লেখযোগ্য সুবিধা উপভোগ করছে। এর আগে চীন এমন সুবিধা ভোগ করত। এছাড়া সীমান্ত অঞ্চলে নিজের দাবির জোরালো করার জন্য শত শত গ্রামও নির্মাণ করেছে চীন। যদিও গ্রাম নির্মাণের বিষয়টি চীন অস্বীকার করে থাকে।
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসি সেন্টার অন এশিয়া অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের গবেষণা সহযোগী বায়রন চং বলেন, এখন যেহেতু ভারত সীমান্ত অবকাঠামোর সুবিধা বুঝতে পারছে, তাই তারা দ্রুত অবকাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করছে। তারা সীমান্ত অবকাঠামোর দিক থেকে চীনের সমান হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে ভারতের এই প্রচেষ্টা চীনের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে এবং বেইজিংকে তার নিজস্ব নির্মাণ প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করতে উৎসাহিত করতে পারে
নবনির্মিত সেলা টানেল আসাম রাজ্য থেকে শুরু হয়ে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং নামক অঞ্চল পর্যন্ত গিয়েছে। এই অঞ্চলটি বেশ সংবেদনশীল একটি অঞ্চল। ফলে টানেলটি বেইজিংয়ের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সেলা টানেল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর অবস্থিত। নয়াদিল্লি বলেছে প্রকল্পটির কারণে সীমান্তে সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি অনেক বেড়ে যাবে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, ২০২২ সালের শেষের দিকে তাওয়াং অঞ্চলে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সংঘর্ষ হয়েছিল। তারপরে, নয়াদিল্লি অভিযোগ করেছে, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সেনারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে একতরফাভাবে অঞ্চলের স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা।
কিন্তু বেঙ্গালুরুর তক্ষশীলা ইনস্টিটিউশন রিসার্চ সেন্টারের ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজের প্রধান মনোজ কেওয়ালরামানির মতে, তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম এবং আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারকে ঘিরে চীনের উদ্বেগের কারণে তাওয়াং অঞ্চলটি বেইজিংয়ের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
দালাই লামার বয়স এখন ৮৮ বছর। তিব্বতের চীনা শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৫৯ সালের ব্যর্থ বিদ্রোহের পর থেকে ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন তিনি। বেইজিং ধর্মীয় অনুশীলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের উপর বেইজিং তার নিয়ন্ত্রণ তৈরির চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে।
মনোজ কেওয়ালরামানির বলেন, অরুণাচল প্রদেশে দালাই লামার উত্তরাধিকার নির্বাচনের ওই বিশেষ মুহূর্তটি কখন ঘটবে তা নিয়ে ব্যাপক চাপ আছে। তখন এই ঘটনায় ভারত কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে বা কী ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে চীনের চাওয়া এবং এর সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে- এসব নিয়ে একটি চিন্তাভাবনা এখন দুই পক্ষের মধ্যেই আছে।
এই বিশেষ এলাকায় টানেল নির্মাণের ফলে ভারত যে সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছে তাতে বেইজিং বড় রকমের চিন্তায় পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
-সিএনএন প্রতিবেদন
সারাবাংলা/আইই
অরুণাচল প্রদেশ চীন তাওয়াং নরেন্দ্র মোদি ভারত শি জিনপিং সেলা টানেল সেলা সুড়ঙ্গ