বিজ্ঞাপন দেখে মেডিকেলে ভর্তি, ৪২ শিক্ষার্থীর স্বপ্নপূরণ অনিশ্চিত
২৩ মার্চ ২০২৪ ১৬:০৫
রাজশাহী: পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে রাজশাহীর শাহমখদুম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ৪২ শিক্ষার্থী। ভর্তির ৩/৪ বছর পর জানতে পেরেছেন ওই কলেজটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নয়। এ ছাড়া ওই কলেজের সনদ বিএমডিসি’র অনুমোদিত নয়। ফলে ৪২ শিক্ষার্থীর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে দেখা দিয়েছে অনিশ্চিয়তা।
এই অবস্থায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টির সুরাহা চেয়েছেন। শনিবার (২৩ মার্চ) দুপুরে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। সমস্যার সমাধান না হলে তারা আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছেন। আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরাও ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মেডিকেল কলেজের নবম ব্যাচের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মুন্না। সঙ্গে ছিলেন একই ব্যাচের ইশতিয়াকুল হাসান ও সাবিয়া খাতুন।
শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, শাহমখদুম কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের প্রত্যেকেই ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়েছে। মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান জিল্লার রহমান (সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন রক্ষার্থে অতি দ্রুত নবায়নযুক্ত মেডিকেলে তাদের মাইগ্রেশনের দাবি জানানো হয়।
লিখিত বক্তব্যে মেডিকেল শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মুন্না বলেন, বাবা-মা লাখ লাখ টাকা খরচ করে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখন চিকিৎসক হওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শাহমখদুম মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান জিল্লার রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীনের প্রতারণার কারণে।
শাহমখদুম মেডিকেল কলেজে ২০২০-২১ সেশন এবং ২০২১-২২ সেশনে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে কলেজে ভর্তি হন তারা। বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, শাহমখদুম মেডিকেল কলেজ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত এবং রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। কিন্তু ভর্তির দুই বছর পার হলে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে শাহমখদুম মেডিকেল কলেজটি বিএমডিসির কর্তৃক অনুমোদন নেই। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নয়। এক কথায় মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের ভুয়া ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে।
এর ফলে শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে সুরাহার জন্য শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান জিল্লার রহমান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (সাবেক সচিব) এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীনকে জানালে তারা বলে কলেজের অধিভুক্তি ও অনুমোদন রয়েছে।
তারা আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের থেকে কয়েক ধাপে উন্নয়ন ফির নাম করে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টাকা নিয়েছে। তারা বলেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তখন আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।
কিন্তু সাবেক সচিবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন যে, শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজের দায়িত্ব থেকে তিনি এরইমধ্যে অব্যাহতি নিয়েছেন। এই কথা বলে তিনি দায়মুক্ত হতে চাচ্ছেন। যেটি কখনোই গ্রহণযোগ্য না। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীনের কাছে গেলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে না, চাইলে শিক্ষার্থীরা তার বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারে তার কোনো আপত্তি নেই।
এরপরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহূর্তের মধ্যে বিনা নোটিশে শিক্ষার্থীদেরকে হোস্টেল থেকে বের করে দেন। এ সময় বলা হয়, হোস্টেল ত্যাগ করতে না পারলে তোমাদের জান ও মালের নিরাপত্তা কেউ দেবে না। এ বিষয়ে আমরা চন্দ্রিমা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি যার তদন্ত চলমান।
শিক্ষার্থীরা বলেন, এখন আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। আমরা চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবসায়ী প্রতারক মনিরুজ্জামান স্বাধীন ও জিল্লার রহমানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আর্থিক, মানসিক এবং সার্বিকভাবে বিপর্যস্ত। আমাদের ৪২ জন শিক্ষার্থী চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পথে। এ বিষয়ে আমরা আদালতে পৃথক পৃথকভাবে ২১টি মামলা দায়ের করেছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের সব দফতরে লিখিতভাবে জানিয়েছি ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলামের বাবা আমিরুল ইসলাম বলেন, তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সন্তানের মেডিকেল পড়াশোনার জন্য তিনি ঋণ করেছেন ৫ লাখ টাকা। একইসঙ্গে তিনি দুই বিঘা ধানি জমি বিক্রি করেছেন ১২ লাখ টাকায়। এখন তিনি টাকা ও সন্তানের জীবন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
তিনি বলেন,‘সন্তানকে এখন দেখে রাখতে হয়। শিক্ষাজীবন, টাকা টেনশনে আত্মহত্যা না করে বসে। আমরা সন্তানদের শিক্ষাজীবন নিশ্চিতের দাবি জানাই।’
এ বিষয়ে মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান জিল্লার রহমান (সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব) বলেন, ‘এক বছর আগে পদত্যাগ করেছি। ভর্তির বিষয়গুলো আমি জানি না। আমি কাউকে ভর্তি করায়নি। কারও থেকে টাকাও নিইনি। আমার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমি কোনো কমিটির মিটিংয়ে যায়নি।’
মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠান। এতে লেখা আছে- শাহমখদুম মেডিকেল কলেজ (শামেক) ২০২০ সালে ৭ম ব্যাচ শিক্ষাক্রম চলমান থাকা অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান ছাত্র-ছাত্রীদের মাইগ্রেশন এবং পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি বন্ধ করেন। এই বন্ধ আদেশটি মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ স্টে করেন। ফলে ২১ ও ২২ সালে আদালতের নির্দেশনার আলোকে দুই ব্যাচে ৪১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ভর্তিকৃতরা সবাই মামলার বিষয়টি জেনে বুঝেই ভর্তি হয়েছে। এখানে প্রতারণার কোনো সুযোগ নেই। মামলা করার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে অথবা অদৃশ্য কোনো শক্তির ইশারায় রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) এই শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরাও পৃথক দুটি মামলা হাইকোর্টে করেছে এবং আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তি করার নির্দেশও দিয়েছেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সরঙ্গ কথা বলব। যেন এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে না পড়ে।’
সারাবাংলা/একে