চট্টগ্রামে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ, দূরত্ব কি বাধা হবে?
২৩ মার্চ ২০২৪ ২২:২৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম থেকে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাস পরিক্রমায় চট্টগ্রামের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে ঐতিহাসিক ছয় দফার পক্ষে প্রথম জনসভা করেছিলেন। সেই ছয় দফা পরবর্তী সময়ে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটি প্রচার হয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে।
ইতিহাসের সাক্ষ্য, চট্টগ্রাম থেকেই মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির প্রায় সব আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল। নয় মাসের যুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরে পরিচালিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’ সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হলেও চট্টগ্রামে নেই কোনো স্মৃতিসৌধ। বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার দাবি উঠলেও এতদিন সেটা উপেক্ষিত ছিল।
তবে এবার পূরণ হতে যাচ্ছে চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবি। স্মৃতিসৌধ নির্মাণের তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। ইতোমধ্যে নগরীর আকবর শাহ থানার দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শনিবার (২৩ মার্চ) দুপুরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সেটি উদ্বোধনও করেছেন। আর তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী একটি স্মৃতিসৌধ মাথা তুলে দাঁড়াবে বলে আশ্বস্ত করেছে জেলা প্রশাসন।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাজনৈতিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে অনুরোধ করেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তবে নগরীর মূলকেন্দ্রে নির্মাণ না করে অনেকটা শহরতলীতে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করায় দূরত্বের কারণে সাধারণ মানুষের সাড়া কতটা মিলবে, সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে বন্দর সংযোগ সড়কের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও স্মৃতিসৌধের’ ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা প্রশাসনের আওতায় থাকা ৩০ একর জমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে এখন ৬২ শতক জমির ওপর অস্থায়ী স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের আদলে এখানেও আছে সাতটি স্তম্ভ। সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভে দেওয়া হয়েছে একটি লোহার বেয়নেট। বেদিতে উঠতে সাত ইঞ্চি করে তৈরি করা হয়েছে সাতটি সিঁড়ি।
স্মৃতিসৌধের সাতটি স্তম্ভ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ এর শ্বাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এ সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসাবে বিবেচনা করে ঢাকার আদলে এ সৌধটি নির্মিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেদি থেকে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধের উচ্চতা ৩০ ফুট। শুধুমাত্র বেদিরই উচ্চতা চার ফুট। বেদির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০ ফুট করে। ১৭ দিনে ১২ জন করে তিন শিফটে মোট ৩৬ জন শ্রমিক কাজ করে এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন।
স্থায়ী স্মৃতিসৌধ করতে আরও চার থেকে পাঁচ বছর প্রয়োজন হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিতে এ অস্থায়ী স্মৃতিসৌধটি করা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
স্থপতি সুমন আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থপতি মঈনুল হক স্যারের করা নকশায় অর্থাৎ জাতীয় স্মৃতিসৌধের আদলেই এটা তৈরি করা হয়েছে। মাত্র ১৭ দিন সময় পেয়েছি। কাজের চাপ নিতে না পেরে ছয় শ্রমিক পালিয়ে গিয়েছিল। এটা জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে ছয়গুণ ছোট। স্থায়ী স্মৃতিসৌধ করতে আরও সময় লাগতে পারে, এখনও নকশা হয়নি। অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ করার জন্য তিনটি ডিজাইন এসেছিল, পরে সিদ্ধান্ত হয় ঢাকার আদলেই করা হবে।’
জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার এ কে এম সরোয়ার কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের দাবি এ স্মৃতিসৌধ আমার জীবদ্দশায় চট্টগ্রামে দেখে যেতে পারব, তা কখনও কল্পনা করিনি। জেলা প্রশাসকের একান্ত প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামে স্মৃতিসৌধ এখন বাস্তবায়নাধীন। এ স্মৃতিসৌধ আমাদের অস্তিত্ব আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। আমাদের ইতিহাসের স্মারক। এবারের ২৬ মার্চ স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তবক অর্পণের মধ্যে দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘদিনের মনের আশা পূরণ হবে।’
এদিকে, উদ্বোধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অসামান্য অবদান আছে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রামে কোনো স্থায়ী স্মৃতিসৌধ ছিল না। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চট্টগ্রামবাসীর অনেকদিন ধরেই একটি দাবি ছিল, এখানে স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হোক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করা হোক।’
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রতি সম্মান রেখে ২০২৩ সালে ৩০ একর জমির ওপর স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। একটি স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ছিল, এ বছরের ২৬ মার্চ উনারা স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে চান। তাদের দাবির মুখে আমরা একটি অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছি। আমাদের বিশ্বাস চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।’
দূরত্বের প্রশ্নে শ্রদ্ধা নিবেদনে যাওয়া নিয়ে সংশয়
চট্টগ্রাম নগরীর মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত নিউমার্কেট মোড় থেকে কাট্টলীর অস্থায়ী স্মৃতিসৌধের দূরত্ব সড়কপথে ১৪ কিলোমিটারেরও বেশি। স্মৃতিসৌধে যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে। সেখান থেকে স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত হেঁটে যেতে সময় লাগবে অন্তত আধাঘণ্টা। এ ছাড়া, নগরীর অলঙ্কার কিংবা সাগরিকা মোড় হয়েও স্মৃতিসৌধে যাওয়া যাবে। কিন্তু শহরতলীর এলাকা হওয়ায় নিয়মিত গণপরিবহনের সংকট রয়েছে। দূরবর্তী স্থানে নির্মিত এ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা।
ঢাকার স্মৃতিসৌধের উদাহরণ টেনে অবশ্য জেলা প্রশাসন বলছে, প্রথমদিকে মানুষের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও ধীরে ধীরে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। বন্দর সংযোগ সড়ক দিয়ে গণপরিবহন চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আগামী ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন কিছু গাড়ির ব্যবস্থা করেছে।
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে স্মৃতিসৌধের দাবি আমাদের সবার ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরে স্মৃতিসৌধ করার জন্য কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি। কোনো খাস জমি নেই। বাধ্য হয়েই কাট্টলিতে অস্থায়ীভাবে স্মৃতিসৌধ করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এবং যাতায়াতে ব্যয় বেশি হওয়ায় মানুষ সেখানে যাবে কি না সেটা চিন্তার বিষয়। তবে আমি মনে করি প্রথমবার একটু কম হলেও আবেগের জায়গা থেকে পরেরবার সেখানেই মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাবে।’
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে স্মৃতিসৌধের অভাব ছিল। অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ করার পর এ অভাব কিছুটা পূরণ হয়েছে। স্মৃতিসৌধটা যদি শহরের এমন জায়গায় করা হতো, যেখানে যাতায়াত সুবিধা ভালো। দক্ষিণ কাট্টলি চট্টগ্রাম শহরের একপ্রান্তে। ওখানে যাওয়ার জন্য ভালো কোনো সুবিধা নেই। যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা না থাকায় ওখানে যাওয়াটা সবার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।’
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঢাকার সাভারে যখন জাতীয় স্মৃতিসৌধ হয়েছিল, তখনও মানুষ প্রথমে কম যেত। কারণ সাভার অনেক দূরে। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ সেখানেই ফুল দিতে যায়। আমরা বেশকিছু গণপরিবহনের ব্যবস্থা করব, যাতে মানুষ এখানে আসতে পারে। প্রতি ঘণ্টায় দুটি পয়েন্ট থেকে বাস ছেড়ে আসবে। সেই বাসে করে মানুষ এখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসতে পারবে।’
ছবি: শ্যামল নন্দী, ফটোকরেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম