Tuesday 03 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দিতে হবে সংরক্ষণ-পরিবহণে

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৫ মার্চ ২০২৪ ১০:২৬ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৪ ১০:২৮

ঢাকা: খাদ্যপণ্যে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কোনো কোনো খাদ্যপণ্যের উৎপাদন দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে অনেক সময়ই সেই পণ্য সঠিক দামে কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। আবার ক্রেতার খরচ লাগামহীন হলেও অনেক সময়ই কৃষকরা পাচ্ছেন না ন্যায্য মূল্য।

এসিআই এগ্রিবিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারী মনে করেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কেবল কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর দিকেই সবাই মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু কৃষিপণ্য উৎপাদন পরবর্তী সংরক্ষণ, পরিবহণ ও বিপণন ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এ কারণে কৃষিপণ্যের বড় একটি অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সর্বোচ্চ উৎপাদনের সুবিধাও পুরোপুরি গ্রহণ করা হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

কৃষিপণ্য উৎপাদন পরবর্তী সংরক্ষণ, পরিবহণ ও বিপণনে এখনই আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থা গড়ে তোলাকে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় মনে করছেন ড. আনসারী। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে বড় পরিকল্পনা নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বব্যাংক বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) অর্থায়নেও এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

সারাবাংলা ডটনেটকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন পরামর্শ দিয়েছেন দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদন, বিপণন ও কৃষিপণ্যে ব্যবহৃত নানা উপকরণ বিক্রিতে যুক্ত অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসিআই এগ্রিবিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফএইচ আনসারী। কৃষি খাতের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সাক্ষাৎকারে তার মতামত ও চিন্তা তুলে ধরেছেন।

দেশে খাদ্যপণ্যের দাম যে প্রায়ই বেড়ে যায়, এর পেছনে উৎপাদন পরবর্তী কার্যকর সরবরাহ ব্যবস্থার অভাবের কারণে ঘটে বলে মন্তব্য করলেন ড. এফ এইচ আনসারী। তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের মধ্যে আমাদের দেশে খাদ্যপণ্যই প্রধান। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, খুব দামি কিংবা কমদামি কাপড়ই পরি না কেন, চিকিৎসা করাই কিংবা না করাই, খাবারটা কিন্তু ধনী-গরিব সবাইকে খেতে হয়। সমস্যা হচ্ছে, কখনো দাম বেড়ে যাচ্ছে, কখনো দাম কমে যাচ্ছে। খাবার উৎপাদন করছে দেশের প্রান্তিক খামারি বা কৃষক, আমরা সাধারণ মানুষ তা কিনছি খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে। এখন, স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে যেটি হয়েছে, আমরা খাদ্য উৎপাদনে সবাই মিলে জোর দিয়েছি। সবকিছুর উৎপাদনও বেড়েছে। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে একটি জিনিস আমাদের মাথায় ছিল না— কৃষক কৃষিপণ্য উৎপাদন করার পর সেই খাবার কিন্তু মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। এটি হবে ভ্যালু চেইনের মাধ্যমে। সেটিই হয়নি।’

বিজ্ঞাপন

আনসারী বলেন, ‘আমরা উৎপাদন করছি। কমবেশি যাই করছি না কেন, তারপরও কোটি টনেরও বেশি খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। গম, ভুট্টা, চিনি ও তেল আনতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কী নেই? আমাদের নেই ফুড ভ্যালু চেইনে পোস্ট হারভেস্টের সল্যুশন। খাদ্য উৎপাদন হলো। সেই খাদ্য তো সংরক্ষণ করতে হবে। না করতে পারলে নষ্ট হবে। গ্রামে সবজি উৎপাদন হচ্ছে, ট্রাকে করে সবজিগুলো আসছে, ট্রাকের ওপর পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিয়ে তার ওপর ঘুমাতে ঘুমাতে পাইকাররা ঢাকায় আসছেন। অর্ধেক সবজির কোয়ালিটি কিন্তু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিংবা পচে যাচ্ছে। আবার এখানে এসে যখন পৌঁছাল, তখন বিক্রি করতে না পারলে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে।’

‘মার্কেটপ্লেসে বা উৎপাদনস্থলে কোল্ড স্টোরেজ থাকলে কিন্তু এগুলো ফেলে দিতে হতো না। এত কষ্ট করে, সার-বীজ-কীটনাশক-ইলেকট্রিসিটি সব খরচ করে যে এত উৎপাদন হলো, সেই উৎপাদন আর ধ্বংস করতে হতো না। ফলে ক্যারি করার জন্য কোল্ড ভ্যান ও রাখার জন্য ওয়্যারহাউজ থাকতে হবে। সরকার এসব ওয়্যারহাউজ বানিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবে, তারা (বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) এসব ওয়্যারহাউজ থেকে সার্ভিস প্রোভাইড করবে। সেবাটা পাবেন খামারিরা, তাদের পণ্য ধ্বংস হবে না এবং বাজারে সবসময় সব ধরনের পণ্য পাওয়া যাবে,’— বলেন ড. আনসারী।

ভ্যালু চেইনের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি আরও তিনি বলেন, ‘মার্কেটগুলোতে গেলে দেখবেন স্যাঁতসেঁতে ভেজা জায়গা। সেখানে খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। অনেকেই খাদ্যপণ্য কোনো একটি দিনে বিক্রি করতে না পারলে পরদিন আর বাজারে নেন না, ফেলে দেন। এই যে পণ্যটি নষ্ট হলো, এটিও কিন্তু ওই পণ্যের দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখে। যেকোনো পণ্যের বাজারজাতকরণে চারটি ‘পি’ আছে। প্রোডাক্ট— পণ্য, যা আপনি বিক্রি করবেন; প্রমোশন— যেভাবে পণ্যটির প্রচার ও যোগাযোগ করবেন; প্রাইসিং— যে দামে পণ্যটি বিক্রি করবেন; এবং প্লেস— যে জায়গাটিতে বসে পণ্যটি বিক্রি করবেন। এখন এই চারটি ‘পি’র মধ্যে যোগসূত্র থাকতে হবে। খাদ্যও একটি পণ্য। এর জন্য আমরা পুরো ভ্যালু চেইনটি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমাদের খাদ্যের অনেক সমস্যাই আর থাকবে না। খাদ্যে অপচয় হবে না, দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী প্রবণতাও দেখা যাবে না। সারাবছর একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যে পণ্যগুলো কিনতে পারব। মৌসুম না থাকলেও সমস্যা হবে না।’

আনসারী বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে এক কেজি ধানও হয় না। এক কেজি চালও হয় না। চিনিও হয় না, তেলও হয় না। অথচ সিঙ্গাপুরে কিন্তু সারাবছর খাদ্যের সংকট থাকে না, দামও সারাবছর প্রায় একই থাকে। কারণ পোর্টে কোনো খাদ্যপণ্য আসা থেকে শুরু করে পরিবহণ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও খুচরা বিক্রি পর্যন্ত সবকিছুকে তারা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে এসেছে। ফলে আমদানিকারকরা সঠিক সময়ে পণ্য বাজারে দিতে পারছেন, ভোক্তাও ঠিক সময়ে পণ্য কিনতে পারছেন। আমাদেরও এখন পোস্ট-হারভেস্টের তথা উৎপাদন-পরবর্তী প্রক্রিয়ায় জোর দিতে হবে। এই অংশে যদি আমরা সক্ষমতা অর্জন করতে পারি, তাহলে দেখা যাবে খাদ্যপণ্যের প্রকৃত উৎপাদন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি সবই বেড়ে গেছে।’

বিভিন্ন সময়ে বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সেই দাম সবাই মেনে চলছে কি না, সেটি মনিটরিংয়ে কিছু মাত্রায় অভিযানও চলে। তবে এই প্রক্রিয়া খুব একটা কার্যকর নয় বলেই মনে করেন ড. আনসারী। এগুলোতে কাজ হয় না উল্লেখ করে বরং ‘ফুড ভ্যালু চেইনে’র সক্ষমতা বাড়ানোর দিকেই মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন তিনি।

ড. আনসারী বলেন, ‘অনেক পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় জরিমানা করা হয়। কিছুদিন আগে কেজিতে তরমুজ বিক্রি করায় এক বিক্রেতাকে জরিমানা করা হয়েছে শুনলাম। অথচ কেজিতে বিক্রি কিন্তু ভালো। কারণ তরমুজ ছোট হোক বা বড় হোক, কেজিতে বিক্রি হলে তাতে কিছু যায় আসে না। এটি বরং ভালো একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু জরিমানা করা হলো। এভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে হয়তো দেখা যাবে খামারিরাই উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। তখন দেখা যাবে পরবর্তী মৌসুমে এর প্রভাব বাজারে পড়বে— সরবরাহ কম হবে, খাদ্যের অভাব হবে এবং উৎপাদনও কমে যাবে। কৃষক ও খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

ফসল উৎপাদন-পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত কার্যকর, উন্নত ও আধুনিক ফুড চেইন কীভাবে গড়ে তোলা যায়— এ প্রশ্নের জবাবে এফ এইচ আনসারী বলেন, ‘ধাপে ধাপে করতে হবে। পিপিপি বা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। বড় কোনো প্রকল্পও নেওয়া যেতে পারে। সরকার শুরু করে দিলে পরে এই খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবেন। আশা করি খুব শিগগিরই আমরা এ বিষয়ে মনোযোগী হতে পারব।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

উৎপাদন-পরবর্তী প্রক্রিয়া এসিআই এগ্রো কৃষি উৎপাদন কৃষি বিপণন খাদ্যপণ্য খাদ্যপণ্য উৎপাদন খাদ্যপণ্য পরিবহণ খাদ্যপণ্য সংরক্ষণ ড. আনসারী ড. এফ এইচ আনসারী ফুড ভ্যালু চেইন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর