এনভিডিয়ার নেতৃত্বে জেনারেটিভ এআইয়ের বড় খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্র
২৯ মার্চ ২০২৪ ১২:২১
উৎপাদনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (জেনারেটিভ এআই) ক্রমবর্ধমান বাজারে একাধিক দিক থেকে আধিপত্য বিস্তার করছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষেত্রভেদে এআই বাজারের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের দখলে।
২০২২ সালে চ্যাটজিপিটি অনলাইনে চালু হওয়ার পর থেকে উৎপাদনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন যাত্রা শুরু হয়। জার্মানভিত্তিক ডাটা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার মতে, বিশ্বব্যাপী জেনারেটিভ এআইয়ের বাজার বছরে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাজারের আকার হবে ২০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই খাতে ইতোমধ্যেই বিস্তৃত উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেটিভ এআইয়ের বাজার গত বছর ছিল ১৬.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যা একই সময়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনের বাজারের চেয়ে তিন গুণ বড়। ২০৩০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে এআইয়ের বাজারের আকার হতে যাচ্ছে ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থাৎ, বৈশ্বিক এআই বাজারের এক তৃতীয়াংশ। এই চিত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থানের উদাহরণ।
জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তিকে চারটি স্তরে ভাগ করা যায়। ভোক্তামুখী অ্যাপ্লিকেশন; মৌলিক প্রযুক্তি যেমন বৃহৎ ভাষা মডেল; ক্লাউড ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং সেমিকন্ডাক্টর।
এআই বাজারের গভীর স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে খুব কম দেশ। যেমন, সেমিকন্ডাক্টর খাতে এআই ব্যবহারের প্রতিযোগিতা একেবারেই কম। ফলে এই খাতে যে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি এআই ব্যবহার করছে তারা একচেটিয়া ব্যবসা করছে।
সেমিকন্ডাক্টর খাতে এআইয়ের ব্যবহারের প্রতীকী হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এনভিডিয়া। এআই চিপমেকার কোম্পানিটি এখন বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলোর মধ্যে আয় ও বাজার মূলধনের দিক থেকে সবচেয়ে বড়।
ডেটা সেন্টার সার্ভারের তথ্য ব্যবহার করে এআই তার শেখার কাজটি করে থাকে। এআই তথ্য কাটছাঁট ও পরিগণনামূলক কর্মকাণ্ড (কম্পিউটিং) করার ক্ষমতা অর্জন করে ডেটা সেন্টার ব্যবহার করে। এআইয়ের নির্ভুলতা বাড়াতে গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিটের (জিপিইউ) সঙ্গে বড় আকারের সমান্তরাল পরিগণনামূলক কর্মকাণ্ড (প্যারালাল কম্পিউটিং) চালানো অপরিহার্য।
জার্মানভিত্তিক আইওটি অ্যানালিটিক্সের তথ্য অনুযায়ী, এনভিডিয়ার ডেটা সেন্টার জিপিইউ ৯২ শতাংশ মার্কেট শেয়ারের মালিক। এনভিডিয়া কত বড় তা বুঝা যায় আরেক মার্কিন প্রতিযোগীর মার্কেট শেয়ারের দিকে তাকালে। এনভিডিয়ার অন্যতম মার্কিন প্রতিযোগী অ্যাডভান্সড মাইক্রো ডিভাইস (এএমডি) মাত্র ৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ারের মালিক।
কেবল সেমিকন্ডাক্টর খাতেই নয়, সফটওয়্যার খাতেও এনভিডিয়ার রয়েছে শক্তিশালী অবস্থান। এনভিডিয়া তাদের প্যারালাল কম্পিউটিং প্লাটফর্ম ও প্রোগ্রামিং মডেল সিইউডিএ ২০০৬ সালে চালু করেছিল। দীর্ঘকাল ধরে তারা এআই ব্যবহার করেছে। এখন এই প্লাটফর্ম ৪০ লাখেরও বেশি ডেভেলপার ব্যবহার করছে।
মার্কিন টেক কোম্পানিগুলো এনভিডিয়ার জিপিইউ-এর বড় ক্রেতা। ফেসবুকের প্যারেন্ট কোম্পানি মেটা জিপিইউ-এর নেতৃস্থানীয় গ্রাহক। মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জুকারবার্গ বলেছেন, তার কোম্পানি একটি পূর্নাঙ্গ ও বড় আকারের অবকাঠামো তৈরি করছে। ফলে এ বছর এনভিডিয়ার কাছ থেকে তারা প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজারটি এইচ১০০ জিপিইউ গ্রাফিকস কার্ড ক্রয় করছে। এ বছরের শেষ নাগাদ এনভিডিয়া এসব জিপিইউ গ্রাফিকস কার্ড মেটার কাছে সরবরাহ করার কথা রয়েছে।
এআইয়ের আরেকটি স্তর ক্লাউড অবকাঠামো। প্রযুক্তি খাতের মার্কিন খেলোয়াড়রা ক্লাউড অবকাঠামোতেও আধিপত্য বিস্তার করে আছে। অ্যামাজন, মাইক্রোসফট এবং গুগল বিশ্বব্যাপী ক্লাউড অবকাঠামো বাজারের দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আইবিএম এবং ওরাকল যোগ করলে মোট বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। ডিজিটাল বিশ্ব রূপান্তরিত হচ্ছে এআইয়ের মাধ্যমে। ক্লাউড অবকাঠামো খাত ইতিবাচক ধারায় বদলে যাচ্ছে এআই ব্যবহারের ফলে। যেহেতু ক্লাউড অবকাঠামো খাতে এসব মার্কিন কোম্পানির বাজার শেয়ার বেশি, তাই লাভের সিংহভাগ তারাই পাচ্ছে। কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত অর্থ প্রবাহের ফলে ফুলেফেঁপে উঠছে।
বৃহৎ ভাষা মডেলেও এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো জেনারেটিভ এআইয়ের অধীনে বৃহৎ ভাষা মডেল এবং অন্যান্য প্রযুক্তি এবং পরিষেবাগুলোর ৮০ শতাংশের বেশি বাজার শেয়ারের মালিক। চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই এবং মাইক্রোসফট এই ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়েছে। অ্যামাজন এবং গুগলও এক্ষেত্রে সক্রিয়।
ভোক্তামুখী অ্যাপ্লিকেশনের ধরন খুব বিস্তৃত। ফলে এই খাতের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে তুলনা করা বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু যখন এই পরিসর বেসিক টেক্সট-জেনারেটিং টুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়, তখন চ্যাটজিপিটি সবার চেয়ে এগিয়ে। স্ট্যাটিস্টার মতে, ২০২৩ সালের নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, বেসিক টেক্সট-জেনারেটিং টুলের ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে মার্কিনভিত্তিক জেনারেটিভ এআই মিডজার্নি ব্যবহার করেন ৫৩ শতাংশ।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, উৎপাদনশীলতা এবং ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হতে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। জেনারেটিভ এআই প্রতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করতে পারে। মার্কিনভিত্তিক পরামর্শ সংস্থা ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোং উৎপাদনশীলতায় এইআইয়ের প্রভাব বুঝাতে যুক্তরাজ্যের জিডিপির উদাহরণ টেনেছে। যুক্তরাজ্যের জিডিপির আকার সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এআই প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতিতে যোগ করবে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এতে উৎপাদনশীলতায় এআইয়ের প্রভাব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
জেনারেটিভ এআইয়ের বাজার শেয়ারের সিংহভাগই একা যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। ফলে লাভেরও সিংহভাগ ভোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে বরাবর চ্যালেঞ্জ জানাতে আগ্রহী কিছু দেশ এ খাতে দখল নিতে উদ্যোগী হয়েছে। এআই উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে চায় চীন। কিন্তু চীনকে বিভিন্ন প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখার কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে চীন।
চলতি মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব যথা সময়ে পেশ করবে বেইজিং। এই পদক্ষেপটি বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে প্রযুক্তি ভাগাভাগিকে উৎসাহিত করবে। এআই বিভাজনকে কাটিয়ে উঠে সেতুবন্ধনে সাহায্য করবে এবং কাউকে পিছিয়ে রাখবে না।’
প্রযুক্তিখাতে আরেক বড় খেলোয়াড় জাপান। জাপানি কোম্পানিগুলো এআই নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু জাপানি কোম্পানির বেশিরভাগ এআই প্রযুক্তি আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যদিও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশ দুটি ঘনিষ্ঠ মিত্র, তাই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরতায় জাপানের আপাতত কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। কিন্তু যদি কোনো ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্তরে পরিবর্তন আসে, তাহলে এই নির্ভরতা জাপানের জন্য কাল হয়ে উঠতে পারে। ফলে এআই প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর জাপানের নির্ভরতা ঝুঁকিমুক্ত নয়।
জেনারেটিভ এআই অবশ্য নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে রেখেছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতে, গুগলে একটি সাধারণ সার্চে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, একই ধরনের সার্চে চ্যাটজিপিটিতে বিদ্যুৎ খরচ হয় ১০ গুণ বেশি। অর্থাৎ, জ্বালানি খাতে এআই-একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
সেই সমস্যাটি সামনে রেখে জাপানের এনটিটি এবং এনইসি আলাদাভাবে শক্তি-সাশ্রয়ী বৃহৎ ভাষার মডেল তৈরির প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। গুগল প্রাক্তন এআই গবেষকরা টোকিও স্টার্টআপ সাকানা এআই চালু করেছেন।
-নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন
সারাবাংলা/আইই