বর্জ্য থেকে মিলছে সার, কেরুর ‘সোনা দানা’ বাড়াবে উর্বরতা
২ এপ্রিল ২০২৪ ১০:২০
চুয়াডাঙ্গা: দেশের একমাত্র সরকারি জৈবসার কারখানা হিসাবে স্বীকৃত চুয়াডাঙ্গা কেরুজ জৈব সার কারখানা। নিজস্ব পরীক্ষাগারে পরীক্ষা শেষে বাজারজাত করা হয় তাদের উৎপাদিত ‘সোনা দানা’ সার। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এ কারখানাটি ২০১২ সাল থেকে উৎপাদন শুরু করে তা এখনও অব্যাহত রেখেছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ মে চুয়াডাঙ্গার আকন্দবাড়ীয়ায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনিকলের বাণিজ্যিক খামারসংলগ্ন প্রেসমাড থেকে জৈবসার প্রস্তুতকরণ প্রকল্পের অফিস ও ল্যাবরেটরি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, বাংলাদেশের আবাদি জমির মাটির উর্বরতা ৫ শতাংশ থেকে নেমে বর্তমানে ১ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। কৃষকরা অধিক ফলনের আশায় ফসলি জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকে। যার কারণে দেশের আবাদি জমির মাটির উর্বরতার হার দিনদিন কমে যাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনিকলের কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাণিজ্যিক খামারগুলোতে প্রায় ১ হাজার একর জমিতে আখ চাষ হয়। এ চাষে প্রতি বছর রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাওয়ার কারণে আখের ফলনও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে জৈবসার। রাসায়নিক সারে উপাদান থাকে ৩টি অথচ কেরুজ উৎপাদিত জৈবসারের মধ্যে ৩২টি প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে। রাসায়নিক সারের চেয়ে ২৯ ভাগ বেশি গুণাগুণ সমৃদ্ধ এ জৈবসার। যা জমিতে ব্যবহার করলে ফসল বৃদ্ধি পাবে এবং মাটির উর্বরা শক্তি সঠিক মাত্রায় বিদ্যমান থাকবে।
বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি করপোরেশনের অধীনে দেশে ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ব চিনিকল রয়েছে। এই চিনিকলগুলোতে কয়েক হাজার একর আবাদি জমি রয়েছে। আবাদি জমির উর্বরা শক্তি এবং অধিক পরিমানে আখের ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে চিনি শিল্পকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন জৈবসার কারখানা স্থাপন করে।
৯ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এ জৈবসার কারখানায় বছরে ৩ হাজার মেট্রিক টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সার উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। সার উৎপাদনের জন্য চিনিকলের আখের উপজাত মোলাসেচ বা প্রেসমাড (আখের বর্জ্য) আর ডিস্টিলারির বর্জ্য স্পেন্টওয়াশ জৈবসার উৎপাদনের মূল উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রতি বছর জৈবসার কারখানায় কাঁচামাল হিসাবে ১৮ হাজার মেট্রিক টন প্রেসমাড ও ৪০ হাজার মেট্রিক টন স্পেন্টওয়াশ প্রয়োজন। এর মধ্যে কেরু চিনিকলে ২ হাজার মেট্রিক টন প্রেসমাড পাওয়া যায়। অবশিষ্ট প্রেসমাড দেশের অন্য চিনিকল থেকে এনে জৈবসার কারখানায় সংরক্ষণ করা হয়।
চিনিকলের আখের উপজাত মোলাসেচ বা প্রেসমাড (আখের বর্জ্য) আর ডিস্টিলারির বর্জ্য স্পেন্টওয়াশের অর্থনৈতিক কোন ব্যবহার এর আগে ছিল না। এ বর্জ্য সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে পরিবেশ দূষিত করতো। এ দু’টি বর্জ্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে এ্যারাবিক কম্পোস্টিং পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব জৈবসার উৎপাদন করা হচ্ছে। প্লান্টেশনের মাধ্যমে প্রেসমাডে মাইক্রোস ছিটিয়ে ৪৮ ঘণ্টা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে সেগুলো পচানো হয়। এরপর চার দিন এরোট্রিলার দিয়ে টার্নেল করে আর্দ্রতা পরীক্ষা করে স্পেনওয়াশ করা হয়। ৪০ দিন স্পেনওয়াশ ও টার্নেল করার পর ২০ ডিগি আর্দ্রতা কমিয়ে ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা করে জৈবসারের গুণগত মান যাচাই করা হয়। এরপর নাইট্রোজেন, সালফার, অর্গানিক কার্বন, সোডিয়াম,পটাশিয়াম ইত্যাদি উপকরণ গুলির মিশ্রণ শেষে প্যাকেটজাত করা হয়।
১ কেজি ওজনের সারের প্যাকেটের দাম ধরা হয়েছে ২৫ টাকা, ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তার দাম ১ হাজার টাকা আর প্রতি মেট্রিক টনের দাম ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ১৬ জন ডিলারের মাধ্যমে এই জৈবসার বাজারজাত করা হচ্ছে।
জৈবসার ‘সোনার দানা’ ধান, পাট, আখ, ভুট্টা, আলু, বেগুন, সিম, ঝাঁলসহ বিভিন্ন ফসল ও ফলের বাগানে ব্যবহার করে সুফল পাচ্ছেন চাষিরা। এছাড়া কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনিকল কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিক খামার গুলোতে ‘সোনা দানা’ জৈবসার ব্যবহার করে আখের ফলন বাড়াচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের চাষি ডালিম বলেন, ‘ইতিপূর্বে বিভিন্ন জৈবসার ব্যবহার করেছি, তবে কেরুর জৈবসার অত্যাধিক ভাল সার। সমস্ত চাষে এ সার প্রয়োগ করা যায়। এ সারের গুণগত মান অনেক ভাল। দিন দিন এ সারের ব্যবহার প্রসার পাবে।’
একই উপজেলার মৃগমারী গ্রামের চাষি জাহিদ জানান, এ জৈবসার ভুট্টা আবাদের জমিতে দিয়েছি, ভুট্টা খুব ভালো হয়েছে। আখ আবাদের জমিতেও ব্যবহার করেছি, সেটারও ফলন ভাল হয়েছে। অন্য জৈবসারের চেয়ে অনেক গুণ ভালো এ সার।
কেরুজ জৈবসার কারখানার প্ল্যান্ট ম্যানেজার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জাকির হোসেন বলেন, ‘দেশের প্রথম জৈবসার কারখানা ২০১২ সালে স্থাপিত এবং উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। তখন থেকেই এর উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এ সার মাটির দূষণ রোধ করে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এ সার একমাত্র সালফারসমৃদ্ধ সার, যা ব্যবহার করলে জমিতে অতিরিক্ত সালফার সার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এ জৈবসার ব্যবহার করে চাষিরা তাদের চাষাবাদে উপকৃত হচ্ছেন। যার কারণে এ জৈবসার উৎপাদন ও বিক্রি উভয়ই বেড়েছে।’
চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, ‘নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ সার উৎপাদিত হয়। এটার ব্যবহার চাষিদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে। জৈবসারের মূল কাজটি হলো মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা। চাষিরা জৈবসার ব্যবহার করে ব্যাপক উপকৃত হয়েছে, যার কারণে চাহিদাও বাড়ছে। আমরা যদি বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে প্রচার ও সম্প্রসারণের কাজটি করতে পারি তাহলে এ সারের বিক্রি ও চাহিদা দিন দিন বাড়বে।’
সারাবাংলা/জেআর/এমও