সাধ-সাধ্যের অসঙ্গতিতে জমছে না ফুটপাতের ঈদ বাজার
২ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪১
ঢাকা: রমজানের ২০ দিন পেরিয়ে গেছে। আর দিন দশেক বাদেই ঈদুল ফিতর। কিন্তু এখনো ফুটপাতের বাজারে কেনাকাটা জমে ওঠেনি। রাজধানী ঢাকার নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ভরসাস্থল এসব মার্কেট বলতে গেলে ঈদের বেচাকেনা শুরুই হয়নি। অথচ প্রতিবছর রমজানের অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই এসব বাজারে ঈদের কেনাকাটা জমে ওঠে।
দোকানিরা বলছেন, ঈদ ঘনিয়ে এলেও বেচাকেনা শুরু না হওয়ায় উদ্বেগে ভুগছেন তারা। বাকি দিনগুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বিক্রি না হলে রীতিমতো লোকসানে পড়বেন। আর ক্রেতারা বলছেন, সব ধরনের পণ্যের দামই আগের চেয়ে অনেক বেশি। এ অবস্থায় সাধ থাকলেও সাধ্যের সঙ্গে তার সমন্বয় ঘটাতে পারছেন না।
সোমবার (১ এপ্রিল) রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে মিরপুর-২ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা এবং ফার্মগেটের ফুটপাতের মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
দিনভর এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দোকানিরা সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছেন ক্রেতার অপেক্ষায়। কিন্তু ক্রেতার আনাগোনা খুব কম। কেউ কেউ দোকানে ঢুঁ মারছেন। তবে বেশির ভাগই দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দরদাম করছেন, কিন্তু বিক্রেতার সঙ্গে দাম নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আর কিনতে পারছেন না। সব মিলিয়ে বেচাকেনা খুবই কম।
মিরপুরের ফুটপাতে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে গেঞ্জির ব্যবসা করছেন মো. ইমন মিয়া। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে বেচাবিক্রি অনেক কম হচ্ছে। জানি না কেন এমন পরিস্থিতি। তবে মানুষের হাতে টাকা নেই বলেই হয়তো তারা কিনছে কম। এ রকম আগে কখনো দেখিনি।’
ফুটপাতের জুতার দোকানি রাকিব উদ্দিন বলেন, এবার রোজার শুরু থেকে বেচাকেনা একেবারে নেই বললেই চলে। আগের কয়েকদিনের তুলনায় গত দুই দিনে বিক্রি একটু বেড়েছে। কিন্তু তা ঈদের বাজার বিবেচনায় কিছুই নয়। গত বছর এই সময়ে দিনে যা বিক্রি করেছি, এবার তার পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।’
পোশাক কারখানাগুলোতে বেতন-বোনাস হলে বিক্রি বাড়বে বলে মনে করছেন রাকিব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টের বেতন বা বোনাস হয়তো এখনো দেওয়া হয়নি। আমাদের কাস্টমারদের বড় অংশই গার্মেন্টসের কর্মীরা। তারা বাজারে না এলে বিক্রি বাড়বে না।’
মিরপুর এলাকার আরেক দোকানদার বলেন, ‘মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নাই। কষ্টে আছে। এখন তো অনেক কাস্টমার দেখি, যাদের দেখলেই বোঝা যায় কখনো ফুটপাত থেকে জিনিসপত্র কেনে নাই। এখন বাধ্য হয়ে কিনতেছেন। আমরা তাদের চলাফেরা দেখলেই বুঝি।’
এই ফুটপাতে নারী-পুরুষের বিভিন্ন ধরনের পোশাক বিক্রি করেন অন্তু। ঈদের বিক্রি কেমন চলছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার দিকে কাস্টমারদের ভিড় একটু বাড়ে। কিন্তু সবাই শুধু দেখে। দামদরও করে। কিন্তু কেনে না। ঈদের তো দেরি নাই। জানি না বাকি দিনগুলায় কী হবে!’
বিকিকিনিতে প্রভাব ফেলছে পণ্যের দামও। বিক্রেতারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় পেশাকসহ সব পণ্যের দামই কিছুটা করে বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা বাড়তি খরচ করতে রাজি নন।
শিশুদের পোশাক বিক্রেতা মাহাদী বলেন, ‘গত বছর একটি গেঞ্জি বিক্রি করেছি ১০০ টাকায়। এ বছর দাম বেড়েছে। ১২০ টাকা দাম চাচ্ছি, কিন্তু ক্রেতারা কেউ দাম জিজ্ঞাসা করে আর দাম বলছে না। কেউ যদি বলেও, ৬০-৭০ টাকার বেশি দাম বলেন না।’
এদিকে ফার্মগেটে ছোটএকটি দোকান চালান বরুণ চক্রবর্তী। বেচাকেনার পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিক্রি হচ্ছে, তবে আশানুরূপ নয়। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় বিক্রি প্রায় অর্ধেক।’
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করছেন ফুটপাতের দোকানি সোহাগ, আকাশ, ফারুক, মেহেদী ও তারেক, রহিম বাদশাসহ আরও অনেকেই। ঈদের বেচাকেনা না জমলে পরিবার নিয়ে তারাই বিপাকে পড়বেন বলে আতঙ্কে ভুগছেন।
একাধিক ব্যবসায়ী সারাবাংলাকে বলেন, ব্যবসা ভালো না হলেও দোকান ভাড়া ও বিভিন্ন চাঁদা তো ঠিকই দিতে হচ্ছে। ফলে তাদের খরচ থেমে নেই। এ অবস্থায় তারা বিপাকে পড়েছেন।
ফার্মগেটের একটি দোকানে কথা হয় রোকন তালুকদারের সঙ্গে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মচারী তিনি। বললেন, ‘বাড়িতে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন আছেন। তাদের সবার জন্য কিছু না কিছু তো কিনতেই হয়। আগে মার্কেট থেকে কেনাকাটা করলেও এখন সে পরিস্থিতি নেই। টাকার কোনো দামই নেই এখন। ফলে ফুটপাত থেকে কিনতে এসেছি। কিন্তু এখানেও স্বস্তি নেই। সব জিনিসের দাম বেশি।’
মিরপুর-১৩ নম্বর থেকে দুই মেয়ের জন্য জামা কিনতে এসেছিলেন মুদি দোকানি সোহরাব। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই মেয়ের জন্য জামা কিনতে চাচ্ছি। কিন্তু অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও সাধ্যের মধ্যে মিলছে না। এবার দাম বেড়েছে অনেক। দোকানিরাও যে দাম চাচ্ছে, তার থেকে আর দাম কমাচ্ছে না।’
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার পেশাক কর্মী বাদ মিয়া ও তার স্ত্রী বলেন, ‘নিজেদের জন্য তো ঈদের মধ্যেই কিছু কেনা হয়। এবারও কিনতে চাই। গ্রামের বাড়ির লোকজনদের জন্য কিছু কেনাকাটা করব। দাম করছি। কিন্তু সবকিছুর দাম বেশি। সে তুলনায় কাপড়ের মান খুব ভালো নয়। দেখি কী করা যায়।’
মিরপুরের মিল্কভিটা এলাকার বাসিন্দা একটি বেসরকারি কোম্পানির বিক্রয়কর্মী শহিদ। তিনি বলেন, ‘নিজের জন্য এক জোড়া জুতা কিনলাম। ৯০০ টাকা দিয়ে যে জুতা কিনেছি, সেটি অন্য সময়ে ছয় থেকে সাত শ টাকায় পাওয়া যেত। ঈদের জন্য দাম বেশি নিয়েছে। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সেই হারে আমাদের আয় তো বাড়েনি। ফলে চেষ্টা করছি ফুটপাত থেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার। কিন্তু সে তুলনায় দাম কম পাচ্ছি না।’
সারাবাংলা/জেজে/টিআর