Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লাখ লাখ টাকা ‘হাতিয়ে নিচ্ছেন’ অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের আনিসুর

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১৬

ঠাকুরগাঁও: ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক আনিসুর রহমান সিন্ডিকেট করে রোগীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

আনিসুর প্রথমে মাইক্রোবাসের হেলপারের কাজ করতেন। পরে ধীরে ধীরে মাইক্রোবাসের চালক হয়ে ওঠেন। মাইক্রোবাস চালানোর সুবাদে হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ২০০৪ সালে জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চালক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ২০০৯ সালে বদলি নিয়ে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে চলে আসেন (যার বর্তমান নাম ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল)। ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আনিসুর। বর্তমানে তিনি নামে-বেনামে গাড়ি, বাড়ি ও সম্পদের মালিক হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের সামনে তার পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি চলাচল করে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। এ ছাড়াও পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে নামে-বেনামে জমি ক্রয় করে হয়েছেন অবৈধ সম্পদের মালিক।

ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ বিধি মোতাবেক কেউ রোগী পরিবহনের জন্য সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিলে কিলোমিটার প্রতি ১০ টাকা হারে ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাল থেকে রোগী রেফার্ডের হাসপাতাল রংপুর মেডিকেল এবং দিনাজপুর মেডিকেল। ঢাকায় যেতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। এর বাইরে অন্য কোনো জেলায় যাওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে রংপুর মেডিকেলে রোগী পরিবহন ভাড়া ২ হাজার ১৬০ টাকা এবং দিনাজপুরে মেডিকেলে পরিবহন ভাড়া ১ হাজার ১৪০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি রংপুরে রোগী পরিবহন করেছেন ২৭৯ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ৩২০০-৪২০০ টাকা হারে ১০ লাখ ২১ হাজার ১৪০ টাকা। সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৬ লাখ ২ হাজার ৬৪০ টাকা। দিনাজপুরে রোগী পরিবহন করেছেন ৫৬ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ১৮০০-২১০০ টাকা হারে ১ লাখ ৯ হাজার ২০০ টাকা, সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৬৩ হাজার ৮৪০ টাকা। রাজশাহীতে রোগী পরিবহন করেছেন ১ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ১৪ হাজার টাকা, সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৭,৮০০ টাকা এবং ঢাকায় রোগী পরিবহন করেছেন ২ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ৩৮ হাজার টাকা। সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন ১৮ হাজার টাকা। রংপুর মেডিকেলে ২১ বার ফ্রিতে গর্ভবতী রোগী পরিবহনের কথা উল্লেখ করা হলেও প্রকৃত পক্ষে ৩-৪ জন ছাড়া কোনো রোগীকেই ফ্রিতে পরিবহন করা হয়নি।

২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রোগীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায় করেছেন ১১ লাখ ৮২ হাজার ৩৪০ টাকা প্রায়। সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। পকেটস্থ করেছেন ৫ লাখ ৮ হাজার ৩৬০ টাকা। তিনি এই সময়ে সরকারের কোষাগার থেকে মেইন্টেনেন্স বিল বাদ দিয়ে ফুয়েল ও মবিল বিল নিয়েছেন ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৪১৪ টাকা। রাজশাহীতে রোগী পরিবহনের কোনো অনুমতি না থাকলেও বিধিবহির্ভূতভাবে রোগী পরিবহন করেছেন তিনি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর শিংপাড়া গ্রামের মাজেদুর রহমান বলেন, ‘আমার বাবা অসুস্থ হলে ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে ভর্তি করাই। পরে ডাক্তার রংপুরে রেফার্ড দিলে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয়। সে জন্য হাসপাতালের ড্রাইভার প্রথমে ৫ হাজার টাকা ভাড়া চায়। পরে ৪২০০ টাকায় রংপুর মেডিকেলে যেতে হয়।’

একই ইউনিয়নের সফিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার শাশুড়ি অসুস্থ হলে ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে ডাক্তার রেফার্ড দিলে সরকারি গাড়িতে রংপুরে নিয়ে যাই, রংপুরে পৌঁছার পরে ড্রাইভার আমাদের কাছে ৩২০০ টাকা ভাড়া নেয়।’

নওগাঁ জেলার মো. শাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘গত ২৮ জানুয়ারি আমার আত্মীয়কে ঠাকুরগাঁও হাসপাতাল থেকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে আসার জন্য ড্রাইভার আমাদের কাছে ১৬ হাজার টাকা ভাড়া চাইলে পরে ১৪ হাজার টাকায় আসতে হয়।’

সম্প্রতি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার সাকোয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ডাক্তার রংপুরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। যেখানে ঠাকুরগাঁও থেকে রংপুর মেডিকেলের ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা। কিন্তু ৫ হাজার টাকার নিচে কোনো গাড়িই যাবে না। আবার অনেকে যেতে চাইলে আরেকজন এসে বাধা দেন। আমরা সব কিছুতেই যেন জিম্মি হয়ে পড়েছি।’

ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমার তো গাড়ি নেই, আমার ভাইয়ের গাড়ি একটা, ভাগ্নেরা গাড়ি চালায়।’

সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ ঠিক নয়। আমি কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নয়। অন্য অ্যাম্বুলেন্স চালকরা সিন্ডিকেট করে, তারা জনগণের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেয়।’

ঠাকুরগাঁও অ্যাম্বুলেন্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন মাহমুদ মামুন বলেন, ‘আনিসুরের ৫টি গাড়ি চলাচল করে। গাড়িগুলো নামে-বেনামে চলে। গাড়িগুলো তার মা, ভাই ও ভাগিনার নামে রয়েছে। এগুলো কথা বলতে গিয়ে আমার ওপর হামলা আসে এবং হুমকিও দেয়।’

অ্যাম্বুলেন্স সমিতির প্রচার সম্পাদক বাবুল ইসলাম বলেন, ‘আনিসুর রহমান তার ভাইকে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছে, তার ভাগ্নেকে গাড়ি কিনে দিয়েছে। কেউ যদি কিছু কম ভাড়ায় যেতে চায় তাহলে তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়।’

ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আমরা তার ট্যাক্সের রির্টান দাখিলের কাগজপত্র যাচাই করি। সেখানে কোনো অসঙ্গতি না থাকায় তার আয় বৈধ বলে ধরে নেই। তবে এর বাইরে কিছু থাকলে তাকে দায় নিতে হবে।’

সারাবাংলা/একে

অ্যাম্বুলেন্স ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর