বাংলাদেশে গোল্ড লোন চালু হবে?
৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১৮
২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চতুর্থ সর্বাধিক ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল সোনা। সোনার দাম অন্যান্য পণ্যের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে শক্তিশালী মূল্য নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। যখন বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলো সমস্যায় পড়ে, তখন প্রায়ই সোনার দাম বেড়ে যায় এবং মানুষ তাদের সম্পদ নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনায় স্থানান্তর করে।
সোনা প্রাথমিকভাবে মুদ্রা বিনিময়ে এবং বিনিয়োগের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর্থিক মাধ্যম হিসেবে সোনা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অন্যান্য ধাতুর তুলনায় আপেক্ষিক ঘাটতি এটিকে ফিয়াট মুদ্রার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থানে তুলে এনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের ফিয়াট মুদ্রার মূল্যের সমর্থন হিসেবে সোনা মজুদ রাখে।
২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের গহনার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। স্বর্ণের বার ও মুদ্রাতে বিনিয়োগ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। আইএনজির পূর্বাভাসে, ২০২৪ সালে প্রতি আউন্স সোনার দাম গড়ে ২,০৩১ ডলার থেকে চতুর্থ প্রান্তিকে ২,১০০ ডলারে পৌঁছতে পারে। মার্কিন ডলার ধীরে ধীরে আবার শক্তিশালী অবস্থায় পৌঁছানোর কারণে ইউএস ট্রেজারি বন্ডের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণের দামও বৃদ্ধি পাবে। স্বর্ণের দাম গত তিন বছরে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৪ ও ২০২৫ সালেও একই ধারা বজায় থাকবে।
ভারতে গোল্ড লোনের প্রসার কেমন?
ভারতের নন-ব্যাংক আর্থিক (এনবিএফসি) প্রতিষ্ঠানগুলো (ব্যাংকের পাশাপাশি) গোল্ড লোনকে রিটেইল লোন পণ্য হিসেবে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। তাদের গোল্ড লোন পোর্টফোলিওতে এনবিএফসির ৬১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, যেখানে ব্যাংকগুলোর রয়েছে বাকি ৩৯ শতাংশ শেয়ার। কিছু কিছু এনবিএফসি ভৌগলিকভাবে বেশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করায় তারা ব্যাংক সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদান করতে পারছে। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের কিছু কিছু ব্যাংক যেমন: এইচডিএফসি, ইন্ডাসইন্ড, ডিসিবি প্রভৃতি ব্যাংক এনবিএফসির সঙ্গে ‘কো-লেন্ডিং’ ব্যবস্থায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে গোল্ড লোন প্রদান করছে। তবে এই ব্যবস্থায় ঋণের ৮০ শতাংশ ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটে প্রতিফলিত হচ্ছে আর অবশিষ্ট ২০ শতাংশ ফি বা কমিশন হিসেবে যাচ্ছে এনবিএফসির খাতায়। যেহেতু ঋণ সংক্রান্ত অর্থায়ন করছে ব্যাংকগুলো আর এনবিএফসিগুলো শুধু গ্রাহক সংযোগ স্থাপন করে দিচ্ছে।
গোল্ড লোন হলো ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ঋণ। গৃহ ঋণ হচ্ছে দ্বিতীয় জনপ্রিয়। ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (আরবিআই) জানিয়েছে, কোভিড প্রাদুর্ভাবের সময় এটি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, কারণ আবেদনের দিন থেকে এক দিনেই এই ঋণ বিতরণ করছে। এছাড়া গ্রাহকরা মনে করেন এটি বেশ ঝামেলামুক্ত ঋণ। সিআরআইএসআইএল রেটিং রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চের হিসাবে ১.৯ ট্রিলিয়ন রুপি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে স্বর্ণের বিপরীতে গ্রহণ করা ঋণের পরিমাণ বেড়ে ২. ৫ ট্রিলিয়ন রুপি হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালের আগস্ট মাসে কৃষি কাজের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্যান্য উদ্দেশ্যে গৃহীত গোল্ড লোনের জন্য লোন-টু-ভ্যালু (এলটিভি) অনুপাত ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করেছে। সেখানে সর্বনিম্ন ১৮ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের জন্য এই ঋণ অনুমোদিত। মেয়াদ সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে সর্বাধিক চার বছর এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটির জন্য গ্যারান্টি প্রয়োজন হয় না। সর্বোচ্চ ঋণের সীমা ১. ৫ কোটি রুপি এবং প্রসেসিং ফি ০-২ শতাংশ পর্যন্ত নিচ্ছে। বিভিন্ন প্রয়োজন যেমন শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে, জরুরি চিকিৎসা, ভ্রমণে যাওয়া, আর্থিক সংকট ইত্যাদির জন্য গোল্ড লোনে দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের দেশে গোল্ড লোনের বাজারের আকার কেমন হবে?
আমাদের দেশে প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ পরিবার বসবাস করছে। শহরাঞ্চলে বাস করে প্রায় ৮১ লাখ পরিবার। গ্রামের পরিবারকে বাদ দিয়ে, ন্যূনতম শহরাঞ্চলের হিসাব অনুযায়ী যদি ধরি, উক্ত ৮১ লাখের মধ্যে অর্ধেক পরিবার, অর্থাৎ ৪০ লাখ লোক ১ ভরি করে স্বর্ণের মালিক, তাহলে প্রায় ৪০ লাখ ভরি স্বর্ণ অব্যবহৃত অবস্থায় বাসা-বাড়িতে পরে রয়েছে। যদি এই পরিমাণ মজুদের অর্ধেকও ধরি, তাহলে এর বর্তমান বাজার মূল্য হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা যা বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত স্বর্ণের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
তার মানে হলো, গোল্ড লোন দেওয়ার মতো বাজারের আকার বাংলাদেশে অন্তত প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বা তার বেশি হতে পারে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৬৩২ মিলিয়ন ডলারের (আনুমানিক ৬,৩২০ কোটি টাকা; ১ ডলার = ১১০ টাকা হিসাবে) স্বর্ণ আমদানি করেছে। এছাড়া, বাংলাদেশে প্রতি বছর অবৈধ উৎসের মাধ্যমে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার সোনা বাজারে প্রবেশ করে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রকৃত আমদানি এবং অবৈধ উৎস মিলিয়ে আমাদের স্বর্ণের বাজারের আকার প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে স্বর্ণের রিজার্ভ ছিল ১০ হাজার ২৫১ কোটি টাকা । ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের দেশে স্বর্ণের বাজারে বিক্রয় ২. ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০৪০ সালে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রত্যেক পরিবারকে উদ্যোক্তা হতে হবে। অথচ ব্যবসা শুরু করতে গেলে আমরা প্রায়ই বলি আমাদের মূলধন নেই, যদিও প্রায় সব পরিবারেই কমবেশি কিছু স্বর্ণ রয়েছে যা আমরা মুসলিম হিসেবে বিবাহ সূত্রে ক্রয় করি অথবা পারিবারিকভাবে পূর্বসূরি থেকে লাভ করি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) বা এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এর মাধ্যমে বাংলাদেশে গোল্ড লোন চালু করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করতে পারে। তবে এই ঋণ তাদেরই দেওয়া হবে যাদের ব্যবসার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অর্থাৎ, কনজিউমার লোন হিসাবে দেওয়া হবে না। ব্যবসা করার প্রয়োজনে ঋণ নেবেন। আর স্বর্ণের দামের মাত্র ৫০ শতাংশ লোন-টু-ভ্যালু হিসেবে সর্বোচ্চ ঋণ দেওয়া যেতে পারে। যদিও ভারতে এই অনুপাত ৭৫-৯০ শতাংশ পর্যন্ত অনুসরণ করা হচ্ছে।
বন্ধকীকৃত সব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে মজুদ থাকবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কাজ করতে পারবে, তা হলো স্বর্ণের বাকি ৫০ শতাংশের মূল্যকে কাজে লাগিয়ে (সামগ্রিক স্বর্ণ মজুদের ৫০ শতাংশকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বন্ড ছাড়া যেতে পারে) বন্ড ছেড়ে সেই টাকা বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করতে পারেন। বিশেষ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আবার তা ঋণ হিসেবে দিতে পারে। এতে করে টাকা মুদ্রণ করে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটার হার কমতে পারে। স্বর্ণ দ্বারা আবৃত্ত বন্ড ইসলামী শরিয়া অনুসরণ করবে। আবার ইসলামী শরিয়া মতে, জামানত হিসেবে স্বর্ণ দ্বারা স্বল্পমেয়াদী তহবিল পেতে যে ঋণ নেওয়া হয় তাকে ‘রহন’ বলে। ফলে চাহিদা (ঋণ গ্রহণ) এবং যোগান (অর্থ সরবরাহের উৎস) দুই দিক থেকেই ইসলামী শরিয়া মানা সম্ভব হবে।
আমাদের দেশের বর্তমান গোল্ড লোনের অবস্থা কেমন?
আমাদের দেশে ব্যাংকগুলো গোল্ড লোন না দিলেও, এই ঋণ অসংগঠিতভাবে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাখারিবাজারকে কেন্দ্র করে গত ৪০০ বছর যাবৎ চালু আছে। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, তাঁতীবাজারে প্রায় ১০ হাজার সোনার দোকান ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৩ হাজার দোকান স্বর্ণালঙ্কার ক্রয়-বিক্রয় ও বন্ধক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে। এই অসংগঠিত বাজারে গ্রাহককে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ৩৫-৬০ শতাংশ হারে, যেখানে বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থায় সুদের হার পড়বে ১৪ শতাংশের কাছাকাছি এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার চাইতে কিছুটা বেশি।
ভারতে মাত্র কয়েক মিনিটেই গোল্ড লোন প্রদান করা হচ্ছে, কারণ তাদের দেশের প্রযুক্তি এবং কমপ্লায়েন্স আমাদের দেশের চেয়ে উন্নত। অর্থাৎ, ন্যানো লোনের মতো দ্রুত এই ঋণ দিতে গেলে আমাদের ভালো মানের অ্যাপস থাকতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে যদি প্রত্যেক গ্রাহকের ক্রেডিট রেটিং চেক করা যায় তাহলে এই ঋণ খুব দ্রুত ডিসবার্স/বিতরণ করা সম্ভব হবে। কারণ এই ধরনের ঋণ এক দিনের মধ্যে বিতরণ করা উচিত।
লেখক: ব্যাংকার, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি
সারাবাংলা/আইই