Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঈদ আনন্দ হারিয়েছে তাদের কাছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১০ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৫৫

ঈদ এসেছে, কিন্তু গাজার শিশুদের কাছে সে ঈদে আনন্দ নেই

গাজার রাফাহর বাসিন্দা লায়ান। বয়স ১১ বছর। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেবল বেঁচে রয়েছে ১৮ মাস বয়সী ছোট বোন সিয়ার। গত অক্টোবরে যখন গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হয়, তখন তারা পুরো পরিবার প্রাণে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিল শহরের আল আহলি হাসপাতালে। তবে তাতে কাজ হয়নি। এক রাতের এক হামলায় মা-বাবা ও আপন পাঁচ ভাই-বোনসহ পরিবারের ৩৫ সদস্যকে হারায় লায়ান ও সিয়ার।

এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষে বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা যখন ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন গাজায় লায়ান ও সিয়ারের মতো হাজার হাজার শিশুদের কাছে ঈদ কোনো উৎসবের বার্তা বয়ে আনেনি। লায়ানের মতো শিশুরা বলছে, তাদের কাছ থেকে ঈদের আনন্দ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।

গাজায় লায়ানের মতো শিশু এখন ঘরে ঘরে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, গাজা ভূখণ্ডে যত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে তাদের বড় একটি অংশ শিশু। আর এসব শিশুদের অনেকেই অনাথ হয়েছে অথবা তাদের দেখাশোনা করার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক কেউ বেঁচে নেই। শুধু তাই নয়, এমন কোনো ক্যাম্প নেই যেখানে শিশুরা মা কিংবা বাবা কিংবা মা-বাবা দুজনকেই হারানোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি।

বিবিসি আরবি বিভাগের আলা রাগায়ি এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, লায়ান ও সিয়ারের পরিবার যেদিন রাতে হামলায় প্রাণ হারায়, জনাকীর্ণ ওই হাসপাতালে সে রাতের হামলায় কয়েক শ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।

১১ বছর বয়সী লায়ান, মা-বাবা ও ভাই-বোন হারানো এই শিশুর কাছে ঈদ আনন্দ হয়ে আসেনি এবার

লায়ান বিবিসিকে বলে, আমাদের পরিবার হাসপাতালে পৌঁছানোর মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের ওপর আঘাত করে। আমি জেগে উঠতেই দেখি, আমার পরিবারের সব সদস্য টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

লায়ান ও তার বোন তাদের এক চাচির সঙ্গে গাজার রাফাহতে একটি তাঁবুতে আশ্রয় পেয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে তার চাচাতো ভাই আলী।

লায়ান বলল, যুদ্ধে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আগে রমজানের শেষের দিকে মা-বাবার সঙ্গে ঈদের জন্য নতুন জামা কিনতে যেত সে ও তার ভাই-বোনেরা। ঈদ এলেই তারা বাড়িতে বিশেষ এক ধরনের বিস্কুট বানাত, যেটি স্থানীয়ভাবে ‘মামোল’ নামে পরিচিত। পরিবারের সবাই মিলে আনন্দে মেতে উঠত।

এবার আর ঈদের এসব কোনো অনুষঙ্গই ধরা দেবে না লায়ানের কাছে। সে বলছিল, এখন ঈদ এসেছে। কিন্তু এই ঈদ আমাদের কাছে অন্য কোনো ঈদের মতো নয়। কারণ যুদ্ধ চলছে। আমরা আমাদের পরিবার হারিয়েছি। এই ঈদ মানে আনন্দ নয়। এ বছর আর কোনো পারিবারিক জমায়েত হবে না। এই ঈদে কেউ আমাদের দেখতে আসবে না।

যুদ্ধের কারণে গাজায় হাজার হাজার লোক চাকরি হারিয়েছে। এই মূহূর্তে লায়ান ও তার বোনের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করছেন তাদের চাচাতো ভাই ২৪ বছর বয়সী আলী। অর্থ স্বল্পতা থাকলেও সামর্থ্যের মধ্যে তিনি তাদের পরিবারের সবাইকে পোশাক ও খেলনা কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

যুদ্ধের আগে গাজা শহরের কাছাকাছি জৈতুনে থাকতেন লায়ানের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ছিল ৪৩ জন। একই ভবনে ছিল তাদের বসবাস। এখন সেই পরিবারের জীবিত সদস্যের সংখ্যা মাত্র আটজন। দক্ষিণ গাজার একটি তাঁবুতে থাকতে হচ্ছে তাদের।

লায়ানের আরেক চাচাতো ভাই ১৪ বছর বয়সী মাহমুদও অক্টোবরের ওই হামলায় মা-বাবাকে হারিয়েছে। তার ভাই-বোনদেরও প্রায় সবাই নিহত হয় ওই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায়।

মা-বাবা হারানো মাহমুদের কাছেও ঈদের আনন্দ শুধুই স্মৃতি

ওই হামলার সময় পরিবারের সদস্যদের জন্য পানি আনতে বাইরে গিয়েছিল মাহমুদ। সে বলছিল, পানি নিয়ে যখন ফিরে এলাম, তখন দেখি আর কেউ বেঁচে নেই। মুখ দিয়ে টুঁ শব্দ করার মতো অবস্থা ছিল না আমার।

বডি বিল্ডিং করত মাহমুদ। তার স্বপ্ন ছিল, বডি বিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন হবে। মিশরে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিল সে। সেসব যুদ্ধের আগের কথা। এখন আর সেসব স্বপ্ন ধরা দেয় না মাহমুদের কাছে। এখন তার একমাত্র ভাবনা, যদি কখনো উত্তর গাজায় নিজেদের ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়া যায়। আর তার দিন কাটে মা-বাবা, ভাই-বোনদের স্মৃতিচারণ করে।

মাহমুদ বলছিল, এই ঈদে কোনো আনন্দ নেই। আমরা আগে ঈদের সময় রাস্তায় বাতি জ্বালাতাম। এখন তাঁবুতে একটু দড়িই কেবল ঝুলানোর সুযোগ রয়েছে। এটাকে ঈদ বলে না।

ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় মা কিংবা বাবা কিংবা দুজনকেই হারিয়েছে— এমন শিশুর সংখ্যা ৪৩ হাজারের বেশি। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না বললেও ইউনিসেফও ধারণা করেছে, গাজা ভূখণ্ডে অন্তত ১৭ হাজার শিশু সঙ্গীহীন অবস্থায় রয়েছে কিংবা যুদ্ধে মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী রয়েছে।

যৌথভাবে রান্নাবান্না

মুসলিমদের মধ্যে ঈদ বলতেই পরিবার ও স্বজনদের একত্রিত হওয়া বোঝায়। দূরদূরান্তে কর্মরত স্বজনরা এই উৎসবে একত্রিত হন। বিভিন্ন স্থানীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী তারা বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি করেন। গাজায় যেসব শিশু এখনো বেঁচে আছে, তাদের এ দুটির কোনোটিই নেই। যারা একটু বড় হয়েছে, তাদের কাছে আগের বছরগুলোর ঈদের স্মৃতিই একমাত্র সম্বল।

যুদ্ধের মধ্যেও কিছুটা ঈদের আমেজ ফিরিয়ে আনতে প্রতিবেশীদের নিয়ে একসঙ্গে বিস্কুট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন মাজদ নাসার

গাজায় ঈদের সময় যেসব ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না ও পরিবেশন করা হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম সুমাকিয়া (মাংসের ঝোল) ও ফাসিখ (লবণাক্ত মাছ)। আর ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকে বিশেষ ধরনের বিস্কুট ‘মামোল’। এগুলোর কোনোটিই আর পারিবারিক আবহে পাওয়ার সুযোগ নেই এসব শিশুদের জন্য।

তাই বলে জীবন তো থেমে নেই। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও জীবনের জয়গান চলছে। রাফাহ শহরের দক্ষিণের একটি ক্যাম্পে অন্তত ১০ জন নারী সবার জন্য মামোল বিস্কুট তৈরির জন্য জড়ো হয়েছেন ফিলিস্তিনি মাজদ নাসার ও তার পরিবারের তাঁবুতে। গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত ২০ বছর বয়সী মাজদ এই উদ্যোগ নিয়েছেন।

মাজদ বলেন, পরিস্থিতি যাই হোক, ঈদ এসেছে। আগের মতো ঈদের আনন্দ আমাদের কারও নেই। শুধু চেষ্টা করেছি, আগের মতো একটু আবহ যেন আসে। ক্যাম্পে থাকা শিশু ও তাদের পরিবারকে যেন কিছুটা হলেও ঈদের স্বাদ ফিরিয়ে দেওয়া যায়। আশপাশে যত তাঁবু রয়েছে, তাদের সবাইকেও তিনি একসঙ্গে মামোল বানানোর আমন্ত্রণ জানান।

ক্যাম্পে থাকা ৬০টি পরিবারের মধ্যে গোল কেক বিতরণ করেছেন মাজদ। মাঝখানে ফাঁপা বা গর্ত করা এই কেকগুলোও স্থানীয় ঐতিহ্য।

সার্কাস আয়োজন

পুরো গাজা ভূখণ্ডজুড়ে এখন প্রায় ১৭ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষকে যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রায় তিন লাখ লোক এই এলাকায় দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছেন। খাবার ও পানীয়ের জন্য এসব মানুষকে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হচ্ছে ত্রাণ সহায়তার ওপর।

মুসতাহা তার সার্কাসের দল নিয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পে ক্যাম্পে, যেন শিশুদের মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফোটে

এ পরিস্থিতিতেও ঈদের সময় উত্তর গাজায় বাস্তুচ্যুত লোকেদের একটি ক্যাম্পে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন একটি সার্কাস দলের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ মুসতাহা। লক্ষ্য একটাই, সার্কাসের খেলা দেখিয়ে শিশুদের যেন একটু হলেও আনন্দ দেওয়া যায়। মুসতাহা বলেন, আমরা শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, যেন তারা ঈদ উৎসব পালন করতে পারে।

এই সার্কাস দলটি ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। যে ভবন থেকে সার্কাসটি পরিচালিত হতো, যুদ্ধে বোমা হামলার আগে সেই ভবনে শিশুদের সার্কাস আর্ট শেখানো হতো। মুসতাহা ও তার দলের ১০ সদস্য পার্কে শিশু ও অনাথদের অভিনয় করে দেখাতেন। এখন ক্যাম্প ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া এলাকায় তারা সার্কাসের খেলা দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন।

মুসতাহা বলেন, প্রতিবার যাতায়াতের সময় আমরা ঝুঁকি অনুভব করি। বেশ কয়েকবার আমরা অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছি। আহতও হয়েছি কয়েকবার। কিন্তু শিশুরা যেন যুদ্ধের দুর্দশা ভুলতে পারে, সে কারণে তাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে সাহায্য করার লক্ষ্যেই আমরা সার্কাসের খেলা দেখানো বন্ধ করিনি, তাতে যত ঝুঁকিই থাকুক।

সারাবাংলা/টিআর

ঈদ ঈদ আনন্দ ঈদুল ফিতর গাঁজা টপ নিউজ ফিলিস্তিন যুদ্ধ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর