প্রাণ ফিরছে আউটার স্টেডিয়ামে, স্বপ্ন দেখছেন ক্রীড়ামোদিরা
১৩ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৩৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন আউটার স্টেডিয়াম মাঠ। আকরাম খান, নাফিস ইকবাল, আফতাব আহমেদ, তামিম ইকবালের মতো অনেক তারকা ক্রিকেটারের জন্ম দেওয়া মাঠটি কালের ব্যবধানে হয়ে পড়েছিল পরিত্যক্ত। জমেছিল কংক্রিট, পাথর আর ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সুইমিং পুল বানিয়ে আবার মাঠের পরিধিও সংকুচিত করে ফেলা হয়েছিল। মাঠের প্রবেশপথ ঘিরে বসানো হয়েছিল রেস্তোঁরাসহ নানা দোকানপাট, এমনকি গণশৌচাগারও।
এভাবেই দিনদিন আউটার স্টেডিয়াম মাঠ চট্টগ্রামের খেলাধুলার জগত থেকে হয়ে পড়েছিল প্রসঙ্গহীন। পাড়ার শিশু-কিশোর, তরুণদের খেলাধুলাও গিয়েছিল নির্বাসনে। বছরের একটি দীর্ঘ সময়জুড়ে বাণিজ্যিক মেলার দখলে থাকত। আর প্রায়ই মাঠটি ব্যবহৃত হতো ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যানের স্ট্যান্ড হিসেবে।
দীর্ঘ সময় পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একটি উদ্যোগ সেই মাঠটিকে আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিচ্ছে। সংস্কারের মধ্য দিয়ে মাঠটিকে আমূল পালটে দৃষ্টিনন্দন রূপ দিতে কাজ চলছে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে। লাগানো হয়েছে ঢাকা থেকে আনা দূর্বা ঘাস। ১১ হাজার বর্গফুট আয়তনের এ মাঠে ফুটবল খেলার মাঠই হবে আট হাজার বর্গফুট আকারের। বাকি জায়গায় অন্যান্য খেলার নানা সুযোগ-সুবিধাও থাকবে। এই কর্মযজ্ঞে অর্থায়ন করছে জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস)।
সম্প্রতি আউটার স্টেডিয়াম এলাকয় গিয়ে দেখা যায়, মাঠের চারপাশে দেওয়া হয়েছে লোহার বেষ্টনী। মাঠজুড়ে রোপণ করা হয়েছে সবুজ ঘাস, যেন মাঠটিতে সবুজ কার্পেট পাতা হয়েছে! ঘাসের পরিচর্যা ও সংস্কারের কাজে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। কেউ মাঠে পানি ছিটাচ্ছেন, কেউ ঘাসের আশপাশে জন্মানো আগাছা কেটে পরিষ্কার করছেন।
একসময় সারা বছরই এ মাঠে বাণিজ্য মেলা, বৃক্ষমেলা, শিল্প মেলা, বিজয় মেলা, স্বাধীনতা মেলা, বৈশাখী মেলা, তাঁতবস্ত্র মেলা, খাদ্য মেলাসহ নানা অনুষ্ঠান চলত। এমনকি ঈদুল আজহার আগে গরু প্রদর্শনীও হয়েছে। এর ফলে মাঠের চারপাশ খানাখন্দে পরিণত হয়েছিল।
স্টেডিয়ামকে তার মূল কাজে ফেরাতে এসব বাণিজ্যিক আয়োজন বন্ধ ঘোষণা করে আউটার স্টেডিয়ামের চারপাশ থেকে সব স্থাপনা উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। এরপর ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর স্টেডিয়াম উন্নয়ন কাজের ভিত্তিস্থাপন করেন জেলা প্রশাসক ও সিজেকেএস সভাপতি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
সিজেকেএস সূত্রে জানা গেছে, আউটার স্টেডিয়ামের চারপাশে ক্রিকেট নেট প্র্যাকটিস, ভলিবলসহ নানা খেলাধুলার ব্লক থাকবে। সুইমিং পুলের দেয়ালের দিকে হবে নেট প্র্যাকটিস ব্লক। স্টেডিয়ামের গ্যালারির দিকে থাকবে ১৫০ থেকে ২০০ মানুষের বসার জন্য গ্যালারি, সার্কিট হাউজ প্রান্ত ও নূর আহমদ চৌধুরী সড়কের প্রান্তে হবে ওয়াকওয়ে। এ ছাড়া বাকি জায়গায় টয়লেট, ড্রেসিং রুম ও বসার ব্যবস্থা থাকবে। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আকরাম খান, নাফিস ইকবাল, আফতাব আহমেদ, তামিম ইকবালের মতো ক্রিকেটাররা এ মাঠে খেলে তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। এ মাঠ ও আশপাশের এলাকা অনেকদিন ধরে অবহেলিত ছিল। এটাকে নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে। সংস্কারকাজ সম্পন্ন হবে দুই ধাপে। মাঠের চারপাশে সুরক্ষা দেয়ালসহ ঘাস রোপণের কাজ প্রায় শেষ। এখন কাঠামোগত কাজগুলো বাকি। বর্ষা আসার আগেই কাজ শেষ হবে।’
জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংস্কারকাজ চলছে, পুরোপুরি শেষ হয়নি। তবে মাঠে এরই মধ্যে ঘাস উঠে গেছে। চারপাশে লোহার গ্রিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন বহিরাগতরা ঢুকতে না পারে। জেলা প্রশাসক স্যার নিজেই পুরো বিষয়টি প্রথম থেকে তত্ত্বাবধান করছেন।’
সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার পর আউটার স্টেডিয়াম ঘিরে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন ক্রীড়ামোদিরা। বিভিন্ন খেলাধুলায় সম্পৃক্ত তরুণ ও সাবেক ক্রীড়াবিদরা বলছেন, মাঠটি সংস্কার শেষে উন্মুক্ত হলে তা আবর শিশু-কিশোর, তরুণদের খেলায় ফেরাবে। মাঠটি আবার হয়ে উঠবে খেলাধুলার কোলাহলে মুখরিত। তা থেকে হয়তো আবারও আকরাম-তামিমদের মতো তারকা জন্ম নেওয়ার পথ সুগম হবে।
জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আউটার স্টেডিয়াম মাঠে খেলেই আকরাম খানেরা ক্রিকেটার হয়েছে। আশীষ ভদ্ররাও এ মাঠে খেলে তারকা ফুটবলার হয়েছেন। আমরাও আউটার স্টেডিয়ামে খেলে আজ সংগঠকের পর্যায়ে এসেছি। সুতরাং চট্টগ্রামে যারা ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট আছেন, এ মাঠ সবার আবেগের জায়গা। মাঠটি একসময় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। এখন সেটাকে আবার সংস্কার করা হচ্ছে, এটা খুবই ভালো উদ্যোগ।’
‘আমি মনে করি, আমাদের যারা পাড়া-মহল্লার শিশু-কিশোররা আছে, মাঠটি তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল নয়, ভলিবল, হ্যান্ডবল এ ধরনের নানা ইভেন্টের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এটাকে স্পোর্টস হাব হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। তাহলে দেখা যাবে, ভবিষ্যতে আবারও এ মাঠ থেকে স্পোর্টসের নানা অঙ্গনের অনেক তারকা খেলোয়াড় তৈরি হবে,’— বলেন সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর।
চট্টগ্রাম জেলা ও প্রিমিয়ার ডিভিশনের ক্রিকেটার পংকজ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ক্রিকেটার তৈরির আতুরঘর এই আউটার স্টেডিয়াম। আমার ক্রিকেটের শুরুটাও এই মাঠেই। বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কারণে এই মাঠটি তার স্বকীয়তা হারাতে বসেছিল। দীর্ঘদিন ধুলাবালি আর বাজে পরিবেশের কারণে এখানে খেলাধুলা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই মাঠটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করায়। কর্তৃপক্ষের কাছে একজন ক্রীড়ামোদী হিসেবে অনুরোধ থাকবে, মাঠটি সংস্কারের পর যেন খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সবাই যেন বিনা বাধায় এই মাঠে খেলাধুলা করতে পারে।’
সারাবাংলা/আইসি/টিআর
আউটার স্টেডিয়াম চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন জেলা ক্রীড়া সংস্থা সিজেকেএস