সারাদেশে যুব বিদ্রোহের বিপ্লবীদের ভাস্কর্য নির্মাণের দাবি
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে’র ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নেওয়া আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনেরা।
বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) সকালে নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বোধন আবৃত্তি পরিষদের উদ্যোগে ‘যুব বিদ্রোহ’ উৎসবে বক্তারা এ আহ্বান জানান।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন, সেই মহান বিপ্লবীদের আদর্শকে তরুণদের সামনে তুলে ধরতে হবে। রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে বিপ্লবীদের বীরত্বগাঁথা সংরক্ষণ এবং সেই ইতিহাস ছড়িয়ে দেয়ার কাজে। দেশের বিভিন্নস্থানে যুব বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ বিপ্লবীদের ভাস্কর্য নির্মাণ করতে হবে। যুব বিদ্রোহের ইতিহাস সংবলিত ভাস্কর্য তৈরি করতে হবে সরকারকে। একইসঙ্গে যুব বিদ্রোহের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সমাজ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।’
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সহ-সভাপতি সুবর্ণা চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাংগঠনিক সম্পাদক গৌতম চৌধুরীর সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, কবি কমলেশ দাশগুপ্ত এবং প্রীতিলতা ট্রাস্টের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য এবং বোধনের অনুষ্ঠান সম্পাদক মৃন্ময় বিশ্বাস।
দুর্জয় পাল ও প্রদ্যুৎ আচার্যের যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। কথামালার পর দলীয় নৃত্য পরিবেশনায় ছিল নৃত্য নিকেতন ও মাধুরী নৃত্যকলা একাডেমি। দলীয় গানে অংশ নেয় সংগীতালয়, উদীচীর একাংশ। এছাড়া একক আবৃত্তি পরিবেশনায় ছিলেন সুচয়ন ললিতকলা কেন্দ্রের তাসকিয়া তুন নূর তানিয়া, নরেন আবৃত্তি একাডেমির পৃথা পারমিতা, কবি ফারহানা আনন্দময়ী ও সারাফ নাওয়ার।
সিপিবি
বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর জেএম সেন হলে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষ মুর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহা, সদস্য ফরিদুল ইসলাম, অমিতাভ সেন ও শীলা দাশগুপ্তা।
এসময় সিপিবি নেতা অশোক সাহা বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে যদি পূর্ণতা দিতে হয়, তাহলে এর গোড়াপত্তন যেখানে হয়েছিল, সেই ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। ভারতবর্ষে স্বাধীনতার জন্য প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে। মাস্টারদার নেতৃত্বে যে যুব বিদ্রোহ, তার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ বপন হয়েছিল, বিপ্লবের বীজ বপন হয়েছিল। যুব বিদ্রোহের আদর্শকে ধারণ করে আমাদের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সা্ম্রাজ্যবাদ বিরোধী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুব বিদ্রোহ এখনও মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
বাসদ
নগরীর জেএম সেন হলে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষ ভাস্কর্যে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে বাসদ চট্টগ্রাম জেলার নেতাকর্মীরা। এসময় বাসদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার ইনচার্জ আল কাদেরী জয়, জেলা সদস্য আহমদ জসীম, পুলক দাশ, মহিন উদ্দিন, প্রগতিশীল আইনজীবী ফ্রন্টের সদস্য মাহমুদুল হসসান, নাজমুল হাসান, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের নেতা নাজিমউদ্দীন বাপ্পি, মোহাম্মদ খোরশেদ, নরুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নগর শাখার সভাপতি মিরাজ উদ্দিন, স্কুল বিষয়ক সম্পাদক উম্মে হাবিবা শ্রাবণী, সদস্য অরুপ মহাজন ছিলেন।
এরপর অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাসদ নেতারা বলেন, ‘আজ থেকে ৯৪ বছর আগে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় মহান চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ। বৃটিশ শাসকদের অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার নির্মম কষাঘাত থেকে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে জীবনপণ বাজি রেখে সেদিন এদেশের তরুণ যুবকরা এই বিদ্রোহের সূচনা করে । স্বদেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই বিদ্রোহের মাধ্যমে তারা ইংরেজ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল । একটি স্বাধীন, মানবিক মর্যাদার ও গণতান্ত্রিক সমাজ, প্রতিষ্ঠা ছিলো এই লড়াইয়ের মূলমন্ত্র। সেই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর আজও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’
যুব ইউনিয়ন
সকালে নগরীর জেএম সেন হলে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায় চট্টগ্রাম জেলা যুব ইউনিয়ন। এ সময় সংগঠনের জেলা সভাপতি মো. শাহ আলম, কেন্দ্রীয় নেতা জাহিদুল ইসলাম সজীব, সাংগঠনিক সম্পাদক রাশিদুল সামির, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক টিকলু কুমার দে উপস্থিত ছিলেন।
পুষ্পস্তবক অর্পণের পর সমবেতদের উদ্দেশে বক্তারা বলেন, ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে এখনো কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। সেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। যুব বিদ্রোহের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর উদ্যোগও নেয়া হয়নি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, বিপ্লবীদের জীবনী পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
উল্লেখ্য, ৯৩ বছর আগে সংঘটিত ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের’ বিশদ বিবরণ গবেষক জামাল উদ্দিনের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’-বইয়ে উল্লেখ আছে। সেখানে লেখা হয়েছে- ‘১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির (বিপ্লবীদের গঠিত সংগঠন) চট্টগ্রাম শাখার সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র লুট করে। মাষ্টারদা সেখানেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।’
অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর রাত পেরোতেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন। জালালাবাদ পাহাড়সহ বিভিন্ন গোপন আস্তানায় আশ্রয় নেন। এরপর চারদিন স্বাধীন ছিল চট্টগ্রাম। পরে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে বৃটিশ বাহিনীর সঙ্গেবিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তিন ঘণ্টার সেই যুদ্ধে ৭০ থেকে ১০০ জন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয় এবং ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন।
অস্ত্রাগার লুন্ঠনে মাস্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্কশেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামে ১৪ বছরের এক কিশোরও ছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/একে