Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইরান-ইসরাইল: সর্বাত্মক যুদ্ধ, নাকি পরিমিত মাত্রার প্রতিশোধ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:৩৩

ইরান এবং ইসরাইল আঞ্চলিক শত্রু। সরাসরি হামলা ও হুমকির খেলায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে তারা। সর্বশেষ দেখা গেল, শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) ভোরে ইরানে সীমিত সামরিক হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।

ইসরাইল এ হামলার কথা স্বীকার করেনি। ইরানের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে বলা হচ্ছে, অন্তত তিনটি ড্রোন ইসপাহান শহরের আকাশ থেকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। ইরানও এই হামলা ইসরাইল করেছে বলে স্পষ্ট করে বলছে না। তবে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে খবর আসছে, এই হামলা ইসরাইলই চালিয়েছে।

গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কেতে ইরানি কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালিয়েছিল ইসরাইল। এতে ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। ইসরাইলি ওই হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল ইরান। গত শনিবার ইসরাইলে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় দেশটি। কয়েক দশকের প্রক্সি যুদ্ধের পর এটাই ইসরাইলে ইরানের ভূখণ্ড থেকে সরাসরি কোনো হামলা। এর পর থেকেই ইসরাইলের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় গোটা অঞ্চল একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। তেল আবিবকে সংযত থাকার জন্য আন্তর্জাতিক মহল ও মিত্ররা পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার পরামর্শ উপেক্ষা করে ইরানে হামলা চালায় ইসরাইল। তবে এই হামলা খুবই নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত।

এই হামলা-পাল্টা হামলায় আন্তর্জাতিক বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে। শুক্রবার সকালে এশিয়ার বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক যুদ্ধের আশঙ্কায় মার্কিন স্টক ফিউচারের দাম পড়ে গেছে।

দশকব্যাপী আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধে জড়িত ছিল ইরান-ইসরাইল। গত অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা কায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালাচ্ছে ইসরাইল। এর পর থেকে ইসরাইল-ইরান উত্তেজনা চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুথিসহ ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ইসরাইলি ভূখণ্ড এবং লোহিত সাগরে ইসরাইলি জাহাজে লাগাতার হামলা চালিয়ে আসছে। অন্যদিকে, প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে একের পর এক হামলা করে হত্যা করে আসছে ইসরাইল।

এতদিন প্রক্সি যুদ্ধের মধ্যেই সংঘাত সীমিত ছিল। ফলে ক্ষয়ক্ষতিও ইরান ও ইসরাইল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু একটি পূর্ণ মাত্রার প্রচলিত যুদ্ধ শুরু হলে উভয় পক্ষের জন্য যেমন তা ধ্বংসাত্মক হবে, তেমনই মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

ইসরাইলের প্রতিক্রিয়ামূলক হামলার পর এখন কী ঘটবে তা নির্ভর করতে পারে ইরানের প্রতিক্রিয়া, ইরান প্রতিক্রিয়া দেখালে ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ের উপর। ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে এই টিট-ফর-ট্যাট কি কেবলই হাতাহাতি লড়াই, নাকি  ইতিমধ্যেই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, নাকি সাবধানে নিয়ন্ত্রিত প্রতিশোধমূলক হামলার চক্র—এটিই এখন বুঝার বিষয়।

আর নয় ছায়া যুদ্ধ?

মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইরান ও ইসরাইল। তাদের উপর কোনো আক্রমণ হলে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রতিশ্রুতি উভয়ই দিয়ে রেখেছে।

শনিবার রাতে ইরানি হামলার পর রোববার ইসরাইল বলেছিল, তারা ইরানের কাছ থেকে এই হামলার সঠিক মূল্য আদায় করে ছাড়বে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বুধবার বলেছেন, মিত্ররা সংযত থাকার পরামর্শ দিলেও শুধুমাত্র তার দেশ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। কখন ও কিভাবে ইরানের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়া জানাবে ইসরাইল, তা একমাত্র তেল আবিবই জানে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ইসরাইল কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা নির্ভর করে মার্কিন সমর্থনের উপর। ওয়াশিংটন ইসরাইলকে সমর্থন করার জন্য লৌহ কঠিন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। তা সত্ত্বেও ইরানের হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নেতানিয়াহুকে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণাত্মক সামরিক অভিযানে অংশ নেবে না।

নেতানিয়াহুর প্রতিশোধমূলক হামলার প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ইরানের উপর ক্ষুদ্রতম কোনো আগ্রাসন হলে তার কঠোর ও ব্যাপক জবাব দেবে তার তেহরান।

র‌্যাপিডান এনার্জি গ্রুপের গ্লোবাল অয়েল সার্ভিসের ডিরেক্টর ক্লে সিগেল বিশ্বাস করেন, একটি পূর্ণ স্কেলের যুদ্ধের সীমারেখা পার করে ফেলেছে ইরান-ইসরাইল। তিনি বলেন, আজকে ইরানের উপর ইসরাইল হামলা করেছে। গত শনিবার রাতে ইসরাইলের উপর হামলা করেছে ইরান। দেশগুলো এখন সরাসরি দেশ যুদ্ধে জড়িত। ছায়া যুদ্ধের অধ্যায়ের অবসান হয়েছে।

ইরানের কোর্টে বল ফিরে এসেছে

তবে বিস্তৃত যুদ্ধের সীমারেখা পার হয়ে গেছে—এ কথার সঙ্গে অনেকেই একমত নন। সামরিক বিশ্লেষকরা ইরানের উপর ইসরাইলের আক্রমণকে ‘আপাত সীমিত প্রকৃতির’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শনিবার রাতে হামলা চালানোর কয়েকদিন আগে থেকে জানিয়ে রেখেছিল ইরান। ইরান আগেই ইসরাইলকে হামলার সময় ও ধরন সম্পর্কে সূত্র দিয়ে রেখেছিল। ফলে ইসরাইল হামলা ঠেকাতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে পেরেছে।

রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা ইউরাশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক ইয়ান ব্রেমার বলেন, ইরানের আক্রমণ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যেন তা ইসরাইল সহজে ঠেকাতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাবেক পরিচালক মাইকেল সিং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, ইরানের হামলাটি ছিল ধীর প্রকৃতির এবং আগেই প্রতিপক্ষকে হামলার ধরন ও মাত্রা জানিয়ে রাখা হয়েছিল। ফলে এটি একটি ব্যর্থ হামলা।

ইসরাইলের পাল্টা আক্রমণের ধরনও ঠিক এমনটাই বলে দাবি করেছেন অনেক বিশ্লেষক। সিগনাম গ্লোবাল অ্যাডভাইজার্সের সিনিয়র বিশ্লেষক বলেন রব ক্যাসি বলেন, আমি মনে করি, এই মুহূর্তে খবরগুলোর শিরোনাম আপনাকে বলবে, ইসরাইলের এই প্রতিশোধমূলক হামলায় যুদ্ধের মাত্রা বাড়বে। কিন্তু আপনি নির্মোহভাবে চিন্তা করলে দেখবেন ইসরাইলে ইরান যে প্রতিশোধমূলক হামলা করেছিল, তার জবাবে ইসরাইল কঠোর কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

ইরানের মাটিতে ইসরাইলের আক্রমণ ছিল খুবই দৃশ্যমান। এটি ইরানের মাটিতে একটি কাইনেটিক এটাক যা কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে করা হয়। আমরা এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছি তাতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ইরানের কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি। ইরানের পারমাণবিক একটি স্থাপনায় এ হামলা চালিয়েছিল ইসরাইল। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা নিশ্চিত করেছে, পারমাণবিক স্থাপনার কোনো ক্ষতি হয়নি।

ইরানি হামলার সমপর্যায়ের প্রতিশোধমূলক হামলা ইসরাইল চালিয়েছিল কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উভয়ই প্রাণহানি বা উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। অনেকে যে রকম পূর্ণাঙ্গ স্কেলে ব্যাপক যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন, তা হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে না।

তবে ইরান-ইসরাইল উভয়ের সঙ্গেই আরও অনেক খেলোয়াড় জড়িত। এখনকার হামলার ধরন ও উদ্দেশ্য যতই সংযত হোক বা না হোক, যে কোনো ভুল হিসাব-নিকাশ প্রতিপক্ষকে আরও গুরুতর সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

রব কেসির প্রশ্ন হলো, এখন একে অন্যের উপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে, এই চক্রটি শেষ হবে কখন? আপাতত একে অন্যের কোর্টে বল ঠেলে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কে সাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই দেখার বিষয়।

ইসরাইল সর্বশেষ হামলা ইরানে চালানোর কারণে বল এখন তেহরানের কোর্টে ফিরে এসেছে। এখন কী ঘটতে চলেছে তা আগামীকাল বা তার পরের দিন বা তার পরের দিন বুঝা যাবে।

সারাবাংলা/আইই

ইরান ইসরাইল টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর