মাছের বরফে তৈরি শরবতেই প্রাণ জুড়াচ্ছে সবাই
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ২২:১৮
ঢাকা: সারাদেশে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। ব্যতিক্রম নয় রাজধানী ঢাকাও। সূর্যের প্রখর তাপ ও গরমে নাকাল জনজীবন। মাঝেমধ্যে গায়ে বাতাস লাগলেও তা যেন আগুনের হল্কা। প্রচণ্ড এই গরমে বেড়েছে রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া শরবতের চাহিদা। চলার পথে রাস্তাঘাটে হাঁপিয়ে ওঠা নগরবাসী গলা ভেজাতে পান করছেন বরফ মিশ্রিত বিভিন্ন শরবত ও আখের রস। কিন্তু এই বরফ কোথাকার তা নিয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
রাজধানীর গুলিস্তান, মতিঝিল, ফার্মগেট, চানখারপুল, পুরান ঢাকার লক্ষ্নীবাজার, পোস্তগোলা, যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ শরবত বিক্রেতারা যে ফিলটার বক্সে শরবত বিক্রি করছেন, তার বেশির ভাগেরই পানি ফিল্টার করার সরঞ্জাম নেই। শুধু ফ্রেম আছে। আর ফিল্টারের ওপরের অংশে বরফ রাখা হয়েছে। লেবুর রস এবং টেস্টি সল্ট মেশানো শরবত বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। কেউ চাইলে গ্লাসে স্যালাইন মেশানো হয়। আবার চাইলে জুসের পাউডারও মেশানো হয়ে থাকে। দাম ১৫ টাকা। এভাবে বিক্রি করা হচ্ছে শরবত।
পল্টন মোড়ের শরবত বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আগে পানির সমস্যা ছিল। বরফ তো আগের জায়গা থেকেই আসে। এখন পানি বিশুদ্ধ। এই পানি, পাম্প থেকে টাকা দিয়ে কিনে আনা হয়। কেউ চাইলে বরফ ছাড়াই শরবত খেতে পারেন। অনেকে বরফ ছাড়াই শরবত বা স্যালাইন মিশিয়ে পান করেন।
বরফের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কিছু ফ্যাক্টরি আছে যারা ভালো পানি বা পাম্পের পানি দিয়ে বরফ তৈরি করেন। সেখান থেকে বরফ কিনলে টাকা বেশি লাগে। আমরা সেখান থেকে বরফ কিনি। আমরা পুরানা পল্টন ও ফকিরাপুল থেকে বরফ কিনেই আনি। অনেক সময় তারা নিজেরাই বরফ দিয়ে যায়।
সেগুনবাগিচা এলাকায় শিল্পকলার সামনে সরবত বিক্রেতা আশরাফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, বরফ কলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে, তারা কি চাইবে বরফ খেয়ে মানুষের ক্ষতি হোক। তারা ভালো পানি দিয়েই বরফ তৈরি করছে। আমি শান্তিনগর বাজার থেকে বরফ কিনে আনি, শরবত বিক্রি করি, হাজার হাজার মানুষ পান করছে, কোনো অভিযোগ শুনিনি এমনকি কেউ করেওনি।
তার কথা মত শান্তিনগর বাজারের ভেতরে মামুনের বরফ কারখানা বলতেই কয়েকজন দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ওই যে বরফ কারখানা। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বরফ বিক্রির হিড়িক পড়েছে। সবাই বরফ নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এক বর্গফুট বরফের দাম ১৫০ টাকা।
নোংরা ও স্যাঁতস্যাতে পরিবেশ হলেও বিক্রেতা মামুনের দাবি, ওয়াসার পানি দিয়েই বরফ তৈরি করা হচ্ছে। সারাদিন ভেজা থাকে তাই পরিবেশ স্যাঁত স্যাঁতে মনে হচ্ছে। এখানকার বরফ সবাই নেয়। বড় দোকান থেকে ফুটপাতের ব্যবসায়ী সবাই নিয়ে যায়। কেউ কোনোদিন অভিযোগ করেনি। কেউ নিয়ে গিয়ে খেলে সে দোষ আমাদের নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু বেইলি রোড নয় রাজধানীর নামকরা অনেক হোটেলও এখান থেকে বস্তায় করে বরফ কিনে নিয়ে যায়। কেউ কেউ বরফ নিয়ে তাদের ডিপ ফ্রিজে রেখে বলে তারা নিজেরাই বরফ তৈরি করেছে।
জানা যায়, দেশের কোথাও খাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ বরফ কারখানা গড়ে ওঠেনি। তাই চাহিদা মেটাতে যত্রতত্র গড়ে ওঠা মাছের জন্য তৈরি বরফের ওপরই ভরসা করছেন শরবত ব্যবসায়ীরা।
অভিযোগ রয়েছে, নোংরা পরিবেশ আর ময়লা মিশ্রিত যেমন তেমন পানি দিয়েই কারখানাগুলোতে বরফ তৈরি করা হয়ে থাকে। এসব বরফ মাছের আড়তের পাশাপাশি সরবত ব্যবসায়ীরাও এনে থাকেন। মাছের এসব বরফ দিয়েই দিনভর ঠান্ডা শরবত বিক্রি করে থাকেন। আর এটা করে থাকেন বেশির ভাগ ফুটপাতে বিক্রি করা শরবত ব্যবসায়ীরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে শরবত বিক্রেতারা বলেন, এই শরবত খেয়েতো কেউ মারা যায়নি। হয়তো দুই-একজনের পেটের সমস্যা হতে পারে। আর এই শরবত শ্রমিক শ্রেণির মানুষই বেশি পান করে থাকে। তাদের কিছুই হয় না।
বিক্রেতারা বলছেন, প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার পানির শরবত বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা শহরের মানুষগুলোই তো খাচ্ছে, কই কারও তো কিছুই হচ্ছে না। যেভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তাতে তো রোগীতে হাসপাতাল ভরে যাওয়া কথা। এই শরবত খেয়ে কয়জন হাসপাতালে গেছেন?
বরফ তৈরির পক্রিয়া দেখতে রাজধানীর জুরাইন কমিশনার গলির আলম বরফ কলে গেলে প্রথমে বাধা দেওয়া হয়। পরে মোবাইলফোন ও কলম জমা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। সেখানে দেখা যায়, ওয়াসার লাইন থেকে সরাসরি পানি বরফের সাচে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এরপর সময় নিয়ে বরফ বের করা হচ্ছে। সেই বরফ চলে যাচ্ছে যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, লক্ষীবাজার ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়।
বরফ কারখানার মালিক আলম বলেন, আমাদের বরফ অনেক ভালো। সেজন্য প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তবে আমরা এই বরফ খাওয়ার কাজে ব্যবহার করতে নিষেধ করি।
খোলা আকাশের নীচে শরবতের দোকান ছাড়াও বিভিন্ন জুস বারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের দাবি তারা নিজেরাই বরফ বানান এবং সেগুলো শরবত ও জুসে দিয়ে থাকেন।
কথা হয় রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের জুস বারের ম্যানেজার রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ডিপ ফ্রিজ দেখিয়ে দিয়ে বলেন, দেখেন আমরা নিজেরাই বরফ তৈরি করছি। আমরা বাইরের বরফ নেই না। অনেকেই নিয়ে থাকে। তারা ফুটপাতে শরবত বিক্রি করে।
নিউ মার্কেটের রহমানিয়া জুস বারের দোকানি মোহাম্মদ আদিল বলেন, আমরা ডিপ ফ্রিজে যে বরফ তৈরি করি তা দিয়ে তিন চার ঘণ্টা চলে। বাকি সময় বাইরে থেকে বরফ আনাতে হয়। ফোন করলে যার যতটুকু দরকার ভ্যানওয়ালা এসে দিয়ে যায়। তারা কাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে আসে বরফ।
চিকিৎসকদের মতে, ফুটপাতের এসব বরফ মিশ্রিত শরবত পানে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। রাজধানীর মহাখালী আইসিডিডিআর‘ বির তথ্য অনুযায়ী এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনে মোট ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল আট হাজার ৮১৫ জন। রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে এসব রোগী এসে চিকিৎসা নেন। যাদের অধিকাংশই ছিল শ্রমিক শ্রেণির।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী সারাবাংলাকে বলেন, বরফ তৈরির জন্য সবার আগে কোনো উদ্যোক্তা তৈরি হতে হবে। এত বড় শহরের মানুষের চাহিদা পুরণের জন্য বিশুদ্ধ একটি বরফ কলও নেই। চাহিদা পুরণের জন্য তো বিকল্প পন্থা অবলম্বন করবেই। তখন তারা মাছের জন্য নোংরা পরিবেশে তৈরি বরফই ব্যবহার করছে। এত এত দোকান, ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ দোকান দেখভালকারী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রয়েছে তারা কতটাতে দেখভাল করবে?
তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার রয়েছে কিন্তু তারা তো অভিযোগ নিষ্পত্তিতেই দিন শেষ। এসব বন্ধ করতে হলে সবার আগে চাহিদা মোতাবেক বিশুদ্ধ বরফ কল দিতে হবে এবং এরপর তদারককারী কর্তৃপক্ষ গঠন করে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সদস্য (খাদ্যভোগ ও ভোক্তা অধিকার) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, লোকবলের অভাবে আমরা মাঠ পর্যায়ে ততটা যেতে পারি না। তবে আমরা গবেষণা কর্ম ও পলিসি লেভেলে কাজ করছি। এক সময় কাজে দেবে। সচরাচর যেসব বরফ দিয়ে শরবত তৈরি করা হচ্ছে তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আগের চেয়ে মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে আরও হওয়া দরকার।
সারাবাংলা/ইউজে/এনইউ