Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চবি শিক্ষকের গবেষণা— মশা মরবে সর্পগন্ধা-নিশিন্দার রসে

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ২২:০৭

চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি ও বিভিন্ন বন-জঙ্গল থেকে ঔষধি গাছ সংগ্রহ করে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক এসব গাছের রস ব্যবহার করেই মশা ও মশার লার্ভা নিধন সম্ভব। ছবি: কোলাজ/ সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: পরিবেশের ক্ষতি না করে কেবল ঔষধি উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে মশা নিধন সম্ভব। এ রকম ২৫০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ আছে, যেগুলোর নির্যাস এডিস, কিউলেক্স ও অ্যানোফিলিস লার্ভা নিধনে কার্যকর। এর মধ্যে অন্তত ১৫টি উদ্ভিদ আছে, যেগুলোর নির্যাস পাঁচ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে মশার লার্ভার মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম।

চট্টগ্রামে এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। নগরজুড়ে মশার তীব্র উৎপাতের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেলের নেতৃত্বে একদল গবেষক গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। যে ১৫টি উদ্ভিদ মশার লার্ভার মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম, সেগুলো নিয়েই এখন মাঠে-ময়দানে বিস্তৃত গবেষণার ওপর জোর দিচ্ছেন গবেষক দল।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারে গত তিন বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণার জন্য চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি ও বিভিন্ন পাহাড়-জঙ্গল এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঔষধি উদ্ভিদ সংগ্রহ করা হয়। নগরীর নালা-নর্দমাসহ প্রজনন স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে ল্যাবে সেগুলোর ওপর ঔষধি উদ্ভিদের নির্যাস প্রয়োগ করা হয়। একইভাবে উদ্ভিদের নির্যাসের সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়েও পরীক্ষা করা হয়।

দফায় দফায় পরীক্ষায় মশা নিধনে ঔষধি উদ্ভিদের কার্যকারিতা নিশ্চিত হয়ে বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ঔষধি উদ্ভিদ সংগ্রহ করে এর পাতা, মূল ও কাণ্ড আলাদা করি। সেগুলো থেকে বিশুদ্ধ নির্যাস সংগ্রহ করা হয়। সেই রস জীবিত লার্ভার ওপর ওয়ান-ড্রপ, টু-ড্রপ, থ্রি-ড্রপ— এভাবে প্রয়োগ করে পর্যবেক্ষণ করি। এ ছাড়া পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। সেখানে ইথানল-মিথানলসহ আরও কিছু রাসায়নিক মিশিয়ে সেগুলো লার্ভার ওপর প্রয়োগ করা হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টা ধরে সেগুলো রেখে দেওয়া হয়।’

বিজ্ঞাপন

ঔষধি গাছপালার খোঁজে সিআরবিতে চবি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল। ছবি: সারাবাংলা

‘উভয় পরীক্ষার পর আমরা দেখতে পেয়েছি, লার্ভা মারা যাচ্ছে। কত দ্রুত মারা যাচ্ছে, সেটা আমরা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখি। ১৫ ধরনের উদ্ভিদের নির্যাস আমরা পেয়েছি, যেগুলো ব্যবহারে পাঁচ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে লার্ভা মারা যাচ্ছে। আমরা এই ১৫ প্রজাতির উদ্ভিদকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। ঔষধি উদ্ভিদ প্রয়োগের মাধ্যমে লার্ভা নিধন করা হলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হবে না,’— বলেন ওমর ফারুক রাসেল।

তবে সেই ১৫ প্রজাতির উদ্ভিদের নাম প্রকাশে সম্মত হননি চবি শিক্ষক রাসেলসহ গবেষণা দলের কেউই।

সারাবাংলার কাছে পাঠানো গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, যে ২৫০ ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে সেগুলো ৭৭টি বিভিন্ন গোত্রের অধীন। এদের মধ্যে ৭৭ টি বীরুৎ, ৫৯টি গুল্ম, ৫৭টি কাষ্ঠল ও ২৪টি লতাজাতীয়।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২৫০ উদ্ভিদের মধ্যে ৫৫টির লার্ভা নিধনের হার ৫০ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া সর্পগন্ধা, বনগাঁদা, ফুলকুড়ি, নাকফুল, গোল মরিচসহ ১৯টি উদ্ভিদের নির্যাস দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে শতভাগ লার্ভা নিধনে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।

মরিচা ফুল, তিত বেগুনসহ চারটি ভিন্ন প্রজাতির গাছের নির্যাস প্রয়োগ করে ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ এবং লাল ভেরেন্ডা, নিশিন্দা, নিম, সাদাচিতাসহ পাঁচটি গাছের নির্যাস দিয়ে ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ মশার লার্ভা নিধন করা সম্ভব হয়েছে।

গবেষণা দলের সদস্যরা চট্টগ্রাম নগরীর পানি জমে থাকা বিভিন্ন স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করছেন। ছবি: সারাবাংলা

এ ছাড়া ভাট ও কাসাভাসহ ছয়টি উদ্ভিদ ৭০ থেকে ৭৯ শতাংশ; শ্বেতদ্রোণ, লেবু ও টমেটোসহ ১০টি উদ্ভিদ ৬০ থেকে ৬৯ শতাংশ; এবং চায়না টগর, কুরমুতাসহ ১১টি উদ্ভিদের নির্যাস ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ মশার লার্ভা নিধনে সক্ষম।

গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করলাম। দেশের সিটি করপোরেশন, সরকার কিংবা যেকোনো সংস্থা যদি পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি না করে মশা নিধনের এ পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহী হয়, তাহলে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা নিতে পারবে। কারণ কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যবহারে ব্যয় যেমন বেশি, তেমনি পরিবেশের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। আবার সেসব কীটনাশকের প্রতি মশার শরীরবৃত্তিয় প্রতিরোধ ক্ষমতাও তৈরি হয়ে গেছে।’

‘এ অবস্থায় রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই শুধু উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে মশা নিধনের প্রায়োগিক পদ্ধতি যদি আমাদের তুলে ধরতে হয়, তাহলে আরও বিস্তৃত পরিসরে মাঠে-ময়দানে গিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। সেজন্য আমাদের ফান্ড লাগবে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমরা অবশ্যই প্রায়োগিক পদ্ধতি আমরা নিরূপণ করব,’— বলেন গবেষক ওমর ফারুক রাসেল।

মশার প্রজনন ও ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর অনুরোধে ২০২১ সালে গবেষণা করেছিলেন চবি শিক্ষক রবিউল ইসলাম ভূঁইয়া ও ওমর ফারুক রাসেলের নেতৃত্বে একটি দল। সেই গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল প্রচলিত রাসায়নিক ব্যবহারে মশা মারার পদ্ধতি প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ার কথা। গবেষক দল মশা নিধনে রাসায়নিকের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে সুপারিশ করেছিল। একইসঙ্গে নালা-নর্দমায় পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ওপরও জোর দিয়েছিল।

বিভিন্ন ঔষধির রস প্রয়োগের পর মশার লার্ভার কী দশা, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে গবেষণায়। দেখা গেছে, কার্যকরভাবেই মশা নিধন সম্ভব। ছবি: সারাবাংলা

কিন্তু গত তিন বছরে সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি চসিক। বরং আগের পদ্ধতিতে কীটনাশক প্রয়োগ করে মশা নিধনের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। একই ওষুধে গত ৩০ মার্চ নগরীতে মশা নিধনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করে চসিক। তবে ওষুধ প্রয়োগের পরও মশা কেন মরছে না, সেটা খতিয়ে দেখতে গবেষণাগার চালুর ঘোষণা দেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে গত দেড় মাসেও সেটি চালু করা যায়নি।

এ অবস্থায় চবির গবেষক দলের আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে জানতে চাইলে চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন যে ওষুধ ব্যবহার করছি, সেটাও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের সুপারিশ অনুযায়ী করছি। সেটা ভেষজ ওষুধ। এরপর নতুনভাবে যদি গবেষণা করে আরও কোনো পদ্ধতি উনারা পান, সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। বিস্তৃত পরিসরে সেই পদ্ধতি প্রয়োগ সম্ভব কি না, সেটা আমাদের দেখতে হবে।’

‘যেমন— ঘরোয়া টোটকাতেও অনেক সময় মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাত্রের মধ্যে লেবু আর এলাচ নিয়ে জানালায় রেখে দিলে মশা আসে না। এগুলো তো ঘরোয়া টোটকা। আমাদের তো ব্রিডিং পয়েন্টে যেতে হবে। গবেষণায় যেসব ওষুধের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো ব্রিডিং পয়েন্টে ব্যবহার উপযোগী কি না বা পদ্ধতিটা কী হবে, এগুলো উনাদের সঙ্গে আলোচনা না করলে বোঝা যাবে না। বিষয়টি আমরা বিবেচনায় রেখেছি,’— বলেন শরফুল ইসলাম মাহী।

গবেষণা দলে আরও ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক ও বর্তমান ১১ শিক্ষার্থী। এরা হলেন— সোহাগ হোসেন, শরীফুল ইসলাম, মো. ইসমাইল, খায়রুল ইসলাম ইভান, ইকরামুল হাসান, সানজানা চৌধুরী নাহিন, খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, সজীব রুদ্র, আরিফ হোসাইন ও সনাতন চন্দ্র বর্মন।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

ঔষধি উদ্ভিদ গবেষণা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল মশা মশা নিধন লার্ভা লার্ভা ধ্বংস লার্ভা নিধন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর