Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আধুনিক যুদ্ধ’ জিততে চীনের সামরিক বাহিনীর বৃহত্তম পুনর্গঠন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ২১:১৪

ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপর সামরিক প্রাধান্য চায় চীন। তাই আধুনিক যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হতে প্রযুক্তিচালিত কৌশলগত শক্তির উপর এবার জোর দিয়েছে বেইজিং। সেই লক্ষ্যে সম্প্রতি সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এক দশকের মধ্যে চীনের সামরিক বাহিনীর বৃহত্তম পুনর্গঠন এটি।

গত সপ্তাহে চীনের নেতা শি জিনপিং কৌশলগত সহায়তা বাহিনী (এসএসএফ) বিলুপ্ত করেছেন। এই সামরিক শাখাটি ২০১৫ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএফ) মহাকাশ, সাইবার, ইলেকট্রনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ক্ষমতাকে একীভূত করার লক্ষ্যে তৈরি করেছিলেন শি জিনপিং।

এসএসএফ বিলুপ্ত করে এবার ইনফরমেশন সাপোর্ট ফোর্স নামের একটি সামরিক শাখা গঠন করেছেন শি জিনপিং। এই শাখার ব্যাপারে শি জিনপিং বলেছেন, এটি পিএলএর একেবারে নতুন কৌশলগত শাখা। নেটওয়ার্ক তথ্য ব্যবস্থার সমন্বিত উন্নয়ন এবং প্রয়োগের মূল ভিত্তি।

গত ১৯ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে শি জিনপিং বলেছেন, নতুন এই শাখা চীনা সামরিক বাহিনীকে আধুনিক যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

একই দিনে একটি সংবাদ সম্মেলনে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এসএসএফকে বিলুপ্ত করে তিনটি ইউনিটে বিভক্ত করার কথা বলেছেন। এগুলো হলো- তথ্য সহায়তা ইউনিট, এরোস্পেস ইউনিট এবং সাইবারস্পেস ইউনিট। এই তিন বাহিনী সরাসরি কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনকে রিপোর্ট করবে। সামরিক কমিশন হলো শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে সামরিক চেইন অব কমান্ডের শীর্ষ ফোরাম।

নতুন কাঠামোর অধীনে পিএলএ এখন চারটি পরিষেবা নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো- সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং রকেট বাহিনী। এছাড়া এখন পিএলএর চারটি শাখা আছে। এগুলো হলো- তিন ইউনিটের এসএসএফ এবং জয়েন্ট লজিস্টিক সাপোর্ট ফোর্স।

চীনা সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুনর্গঠনের কারণে পিএলএর কৌশলগত ক্ষমতার উপর শি জিনপিংয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। এই পুনর্গঠনে ভবিষ্যতের ইন্টেলিজেন্ট ওয়ারফেয়ারে (তথ্যযুদ্ধ) প্রস্তুত হতে এআই এবং অন্যান্য নতুন প্রযুক্তিকে আরও ভালোভাবে আয়ত্ত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

গত বছর পিএলএর অভ্যন্তরে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিলেন শি জিনপিং। শুদ্ধি অভিযানে ক্ষমতাধর অনেক জেনারেল ধরা পড়েন। শুদ্ধি অভিযানে বিশেষ করে চীনের রকেট বাহিনীতে নাড়া পড়ে। রকেট বাহিনী হলো চীনের একটি অভিজাত সামরিক শাখা। এই বাহিনী চীনের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক মিসাইল অস্ত্রাগারের তদারকি করে। এবারের পুনর্গঠন শুদ্ধি অভিযানেরই একটি ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন চীনের বিশ্লেষকরা।

উল্লেখ্য যে, নবগঠিত তথ্য সহায়তা বাহিনী অধুনালুপ্ত এসএসএফের শীর্ষ জেনারেলদের নেতৃত্বেই থাকবে। এসএসএফের ডেপুটি কমান্ডার বি ই’কে নতুন ইউনিটের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছে। চীনের সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার খবরে বলা হয়েছে, এসএসএফের রাজনৈতিক কমিসার লি ওয়ে তথ্য সহায়তা বাহিনীতেও একই ভূমিকা পালন করবেন।

এসএসএফ কমান্ডার জু কিয়ানশেংয়ের অবশ্য নতুন কোনো দায়িত্বের খবর পাওয়া যায়নি। গত বছর শুদ্ধি অভিযানের সময় দুর্নীতির অভিযোগে অন্যান্য অভিযুক্ত জেনারেলদের মতো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন জু কিয়ানশেং। এতে অনেক জল্পনা ছড়িয়েছিল। অবশ্য গত জানুয়ারির শেষের দিকে একটি সম্মেলনে তাকে আবার প্রকাশ্যে দেখা যায়।

আরও বেশি তদারকির সুযোগ

দীর্ঘদিন ধরে পিএলএর দিকে নজর রাখছেন এমন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক পুনর্গঠন সাম্প্রতিক দুর্নীতি শুদ্ধি অভিযানের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, বরং এসএসএফ চীনের সামরিক বাহিনীর জন্য আদর্শ সাংগঠনিক বিন্যাসে ছিল না। তাই এটি বিলুপ্ত করে সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়েছে।

মার্কিন পেন্টাগনের অর্থায়নে চলা ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির সিনিয়র গবেষক জোয়েল উথনো বলেন, এসএসএফ পিএলএর জন্য কোনো সন্তোষজনক ব্যবস্থা ছিল না। এসএসএফের গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্য শি জিনপিংয়ের দৃশ্যমানতা হ্রাস করেছে। মহাকাশ, সাইবার এবং নেটওয়ার্ক প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের কোনো উন্নতি করেনি এসএসএফ।

বিলুপ্তির আগে এসএসএফের দুটি প্রধান ইউনিট ছিল। সেগুলো হলো- অ্যারোস্পেস সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট- যা পিএলএর স্পেস অপারেশন এবং পুনরুদ্ধার বিষয়ে তত্ত্বাবধান করত। আরেকটি হলো নেটওয়ার্ক সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট- যা সাইবার, ইলেকট্রনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সক্ষমতা নিয়ে কাজ করত।

জোয়েল উথনো বলেন, আমি মনে করি নতুন কাঠামো শি জিনপিংকে মহাকাশ, সাইবারস্পেস এবং নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় আগের চেয়ে ভালো নজরদারির সুযোগ দেবে। এই ফাংশনগুলো এখন শি জিনপিংয়ের পর্যায় থেকে তত্ত্বাবধান করা হবে। আগে এসব বিষয় স্ট্র্যাটেজিক সাপোর্ট ফোর্সের মাধ্যমে তত্ত্বাবধান করা হতো— যা শি জিনপিং ও এসএসএফের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত।

সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এ ধরনের দৃশ্যমানতার অভাব ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা এবং গভীর অবিশ্বাসের সময়ে সামরিক বাহিনীর সবকিছু সর্বোচ্চ নেতৃত্বের চোখের সামনে থাকা জরুরি।

গত বছর চীনের নজরদারি বেলুন গুলি করে ধ্বংস করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই ঘটনাটি দুই শক্তির মধ্যে নতুন সংকট তৈরি করে। কয়েক মাস ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থবির হয়ে পড়ে।

মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, বেলুনটি চীনা সামরিক বাহিনীর বিস্তৃত নজরদারি কর্মসূচির অংশ ছিল। তবে ধারনা করা হচ্ছে, শি জিনপিং এই নজরদারি কর্মসূচির বিষয়ে অবগত ছিলেন না।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত জুনে বলেছিলেন, চীনা নেতা শি জিনপিং বেলুনটি সম্পর্কে জানতেন না। মার্কিন আকাশসীমায় উড়ার পর যখন এটি গুলি করে নামানো হয়েছিল তখন শি জিনপিং খুব বিব্রত হয়েছিলেন।

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন রিসার্চ ফেলো জেমস চার। তিনি বলেন, গুপ্তচর বেলুনের ঘটনার সময় কৌশলগত তথ্য সংগ্রহের কাজ এসএসএফের অ্যারোস্পেস সিস্টেমস বিভাগের অধীনে ছিল। এটি ছিল পিএলএফএসএসএফ-এর অন্যতম ভূমিকা ও দায়িত্ব।

বেলুনের ঘটনাটি এসএসএফ ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে শি জিনপিংকে প্রভাবিত করেছে কি না তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।

ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির গবেষক উথনো বলেন, নবগঠিত ইনফরমেশন সাপোর্ট ফোর্স সম্ভবত পিএলএর জন্য যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে।

রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক প্রতিরক্ষার মতো বিষয়গুলোতে পিএলএর পারদর্শিতা অর্জন করা ভবিষ্যতের যে কোনো সংঘাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা এই ফাংশনগুলোর প্রতি গভীর মনোযোগ দিচ্ছে এবং সম্ভবত ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে তাদের নিজস্ব সংগঠনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করছে। সম্ভাব্য তাইওয়ান আক্রমণ সামনে রেখে শিক্ষা কাজে লাগাতে চাচ্ছে বেইজিং।  সুতরাং এটা বোঝা যায় যে, সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান শি জিনপিং এই এলাকায় আরও সরাসরি ভূমিকা পালন করতে চাইবেন।

ইন্টেলিজেন্টাইজড ওয়াফেয়ার

জেমস চারের মতে, সামরিক বাহিনী কীভাবে ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলো আরও ভালোভাবে পূরণ করতে পারে তার একটি চলমান পর্যালোচনার ফলাফল সম্ভবত সাম্প্রতিক এই পুনর্গঠন। তিনি বলেন, আমি মনে করি, পিএলএ তথ্যযুদ্ধের বিকাশকে ত্বরান্বিত করার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। পুনর্গঠনের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত এবং শিল্পগত অগ্রগতির একটি নতুন ধারা শুরু হয়েছে।

২০১৯ সালে সামরিক বাহিনীর জন্য একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। শ্বেতপত্রে তথ্যযুদ্ধের ধারণাটি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। শ্বেতপত্রে এআই, কোয়ান্টাম তথ্য, বিগ ডেটা এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সামরিক প্রয়োগের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

শ্বেতপত্রে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সামরিক প্রতিযোগিতার ল্যান্ডস্কেপ ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ-প্রযুক্তিগত সামরিক প্রযুক্তি প্রতি দিন বিকশিত হচ্ছে। দূর-পাল্লার নির্ভুলতা, বুদ্ধিমত্তা, স্টিলথ বা মনুষ্যবিহীন অস্ত্র এবং সরঞ্জাম আপডেটের প্রচলিত প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে তথ্যভিত্তিক যুদ্ধের বিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের অধীনে সরাসরি একটি নতুন শাখা হিসেবে তথ্য সহায়তা বাহিনী গঠন করে আধুনিক যুদ্ধে তথ্যে আধিপত্যের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন শি জিনপিং।

চীনা সামরিক বাহিনীর অফিসিয়াল মুখপত্র পিএলএ ডেইলিতে একটি ভাষ্যে নেটওয়ার্ক তথ্যপ্রযুক্তিকে যুদ্ধের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভেরিয়েবল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, আধুনিক যুদ্ধগুলো সিস্টেম এবং কাঠামোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা, যেখানে তথ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধের উপর নিয়ন্ত্রণের সমান।

তথ্যের আধিপত্য এবং ইন্টেলিজেন্টাইজড যুদ্ধের উপর জোর দেওয়ার বিষয়টি তাইওয়ান প্রণালীতে ভবিষ্যতে যে কোনো সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য উল্লেখযোগ্য। জেমস চার বলেন, তাইওয়ানের সংঘাতের ক্ষেত্রে তথ্য সহায়তা বাহিনী সম্ভবত একটি অগ্রসর বাহিনী বা বর্ষার ডগার মতো কাজ করবে।

সারাবাংলা/আইই

ইন্টেলিজেন্টাইজড ওয়াফেয়ার চীন টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর