উত্তরে খরা, প্লাবনের শঙ্কা উত্তরপূর্বে
৪ মে ২০২৪ ২১:৫২
ঢাকা: যখন তাপদাহে পুড়ছে গোটা দেশ, ঠিক তখনি দেশের আরেক প্রান্ত ডুবছে বৃষ্টি আর ঢলে। টানা তাপপ্রবাহে দেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলে খরা দেখা দিয়েছে। তীব্র গরমে হাওরের ফসল ভালো হলেও উত্তরাঞ্চলে আম, লিচুর বোটা শুকিয়ে ঝরে গেছে গুটি। ক্ষতির মুখে আমন চাষিও। পানির অভাবে খেতেই শুকিয়ে যাচ্ছে ভুট্টার মতো রবি ফসল। এদিকে কয়েকদিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের নিম্নাঞ্চল ডুবতে শুরু করেছে, বাড়ছে নদ- নদীর পানি।
এক দেশের দুই প্রান্তে দুইরকম চরম আবহাওয়ার দেখা মিলছে এই গ্রীষ্ম মৌসুমে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গ্রীষ্ম মৌসুমে তাপমাত্রা বাড়তি থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু গত দুই তিন বছর ধরে যে পরিস্থিতি সামনে এসেছে তা মোটেই স্বাভাবিক নয়। এর জন্য তারা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দুষছেন।
বাংলা বর্ষপুঞ্জি অনুযায়ী— বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য গ্রীষ্ম কাল। অন্য ঋতুগুলোর তুলনায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে তাপমাত্রার পারদ এতটাই বেড়েছে যে ত্রিশ, চল্লিশ বছরেরও রেকর্ড ভেঙেছে।
বাংলাদেশে গত এক মাসের আবহাওয়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে ছিল। এরমধ্যে চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে কয়েকদিন। আবহাওয়াবিদদের মতে এই পরিমাণ তাপমাত্রা স্বাভাবিক বলা যায় না।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহম্মদ আবুল কালাম মল্লিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে আমরা দুর্যোগ বলে থাকি। কিন্তু গত দুই থেকে তিন বছর ধরে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রির ওপরে উঠেছে। তার আগে ৪০ ডিগ্রির রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। তারও তিন দশক আগে তাপমাত্রার বর্তমান পরিস্থিতি রেকর্ড হয়েছে। তবে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে কখনো পৌঁছায়নি।’
তিনি বলেন, ‘৪০ কিংবা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হলেও অনুভূত হয় তার চেয়ে দুই ডিগ্রি বেশি। যে কারণে গরম তীব্র অনুভূত হয়। আর রোদের তাপে মানুষের অস্বস্তি যেমন হচ্ছে তেমনি কৃষির ক্ষতি হয়।’
শনিবারও (৪ মে) দেশের পাবনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাট জেলা সমূহের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। চাঁদপুর ও মৌলভীবাজার জেলাসহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল বিভাগ এবং ফুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময় সারাদেশে দিনের এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
সংস্থাটি আরও বলছে, এ পরিস্থিতি রোববারও (৫ মে) দেশের পশিচমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে বিরাজমান তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। তবে ওই দিন সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেতে পারে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। তবে রাজধানী ঢাকায় রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
টানা তাপপ্রবাহে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষির ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, পাবনা, নাটোর অঞ্চলে আম ও লিচুর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খরার কারণে আম ও লিচুর বোটা শুকিয়ে গুটি ঝরে যাচ্ছ। ক্ষতি হচ্ছে ফসলেরও। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে— তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রিতে উঠলেও ধানে চিটা দেখা দেয়। সেখানে এক মাস ধরে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে এ সব এলাকার তাপমাত্রা। তীব্র খড়ায় ভুট্টা, তিল বাদামের মতো রবিশস্য শুকিয়ে মাঠেই নষ্ট হচ্ছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চল গত কয়েকদিন ধরেই কখনো বজ্র বৃষ্টি কখনো শিলা বৃষ্টি হচ্ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদফতর আর শ্রীমঙ্গলে ১২ মিলিমিটার। এছাড়া চট্টগ্রামে ২৭ মিলিমিটার, কুমিল্লায় সর্বোচ্চ ৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে ৫ মিলিমিটার, ফেনী ও টেকনাফে ২০ মিলিমিটার, কুতুবদিয়ায় ২৭ মিলিমিটার, ভোলাতে ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। একই সঙ্গে সুরমা, কুশিয়ারা, পিয়াইন, ধলাই ও সারিসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানিও বাড়তে শুরু করেছে। শুক্রবার (৩ মে) সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত তা অপরিবর্তিত ছিল। এ ছাড়া কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ তথ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের।
অন্যদিকে উজানের ঢলে ও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ও জৈন্তাপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী— বৃহস্পতিবার (২ মে) সকাল ৯টায় সুরমা নদীর কাইনাইঘাট পয়েন্টে ১১ দশমিক ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল যা ছিল বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার ওপরে। রাত ৯টায় তা আরও বেড়ে ১১ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শুক্রবার ৯টা পর্যন্ত পরিস্থিতি অপরিবর্তিত ছিল।
সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জৈন্তাপুর উপজেলার নয়াবাড়ী, ফুলবাড়ী, কেন্দ্রী, ডিবিরহাওর, ঘিলাতৈল, মুক্তাপুর, বিরাইমারা হাওর, খারুবিল, চাতলারপাড়, ভুলটিরপাড়, ১ নম্বর লক্ষ্মীপুর, ২ নম্বর লক্ষ্মীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, কাঁঠালবাড়ীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন এ সব এলাকার কৃষক।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েকদিনের বৃষ্টিপাত ও ঢলে বৃহস্পতিবার থেকে জৈন্তাপুরে নদ-নদীতে পানি বাড়তে থাকে। কিন্তু আজ শনিবার (৪ মে) সারাদিন আবহাওয়া রৌদ্র-উজ্জ্বল থাকায় পানি আর বাড়েনি বরং জমে থাকা পানি নেমে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার হাওর এলাকার ফসল প্রায় সবই উঠে গেছে। তাই নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হলেও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।’
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী— সিলেট ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর অববাহিকায় অন্যান্য জেলাসমূহের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী— আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে হালকা থেকে মঝারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এ সময়ে সিলেট জেলার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে, অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর অববাহিকায় অন্যান্য জেলাসমূহের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানিয়েছেন, আগামী ৪৮ ও ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি এবং কোথাও কোথাও অতিভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এ সময়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
অন্যদিকে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতল স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল কতিপয় পয়েন্টে স্বল্প মেয়াদে প্রাক- মৌসুমি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
সারাবাংলা/জেআর/একে