টিম স্মার্টকে ধন্যবাদ জানাল নাসার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী কিশোররা
৭ মে ২০২৪ ২২:৩৮
ঢাকা: নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগী বিশ্বের ৫৫টিরও বেশি দেশের প্রায় সাড়ে তিন হাজর শিক্ষার্থী। বৈশ্বিক সম্মানজনক এই প্রতিযোগিতার এবারের চূড়ান্ত আসরে প্রায় ৯ বছর পর অংশগ্রহণের সুযোগ পায় বাংলাদেশি কিশোরদের দল ‘নট আ বোরিং টিম’। তাতেই বাজিমাত— দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম আর সারা বিশ্বে পঞ্চম স্থান অর্জনের গৌরব নিয়ে ফিরেছে দলটি।
তবে নাসার পথে গৌরবের এই যাত্রার পথটি সুগম তো ছিলই না, বরং একপর্যায়ে সেই যাত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কারণ নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে প্রতিযোগিতার যে চূড়ান্ত পর্ব হওয়ার কথা, সেখানে যাতায়াতের টাকাই জোগাড় হচ্ছিল না। পাঁচ কিশোরের দলটি দুজনে নেমে এলেও টাকার অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তাদের যাত্রা। ঠিক এমন একটি সময়ে এই কিশোরদের পাশে আলো হয়ে দাঁড়ায় বেসিসের কিছু সদস্য প্রতিষ্ঠান, অ্যাডভান্সড ইআরপি বিডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের নেতৃত্বে যারা ‘টিম স্মার্ট’ প্যানেল হয়ে এবারের বেসিস নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
কনরাড চ্যালেঞ্জের চূড়ান্ত পর্বের আনুষ্ঠানিক নাম ‘ইনোভেশন সামিট’। এতে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে। ‘নট আ বোরিং টিম’ এই পর্বে ‘এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ ক্যাটাগরিতে অংশ নেয় ‘এক্সো ম্যাক্স স্মার্ট রোড সেফটি বিস্ট’ প্রকল্প নিয়ে, শীর্ষ ৭ হিসেবে।
দলটির সদস্য পাঁচজন— নওগাঁ নাজিপুর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নাদিম শাহরিয়ার, নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের মাহ্দী বিন ফেরদৌস, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের নুর আহমাদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের হরিমোহন সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ত্ব-সীন ইলাহি এবং রাজধানীর লরেটো স্কুলের শিক্ষার্থী সানজীম হোসেন। দলের মেন্টর ছিলেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) মেহেদি হাসান।
ত্ব-সীন ইলাহি জানাল, ‘এক্সো ম্যাক্স স্মার্ট রোড সেফটি বিস্ট (এসআরএসবি)’ মূলত একটা গাড়ির গিয়ার বা যন্ত্রাংশ। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ নকশার মাদারবোর্ড, ভাইব্রেটর, রিডার সেন্সর, টেকোমিটার, ক্যামেরা ও অ্যাকসিডেন্ট ডিটেক্টর। চালকের মুখোমুখি থাকবে প্রতিটি কম্পোনেন্টের সঙ্গে যুক্ত ডিসপ্লে। থাকবে ভয়েস সেন্সর, যা প্রয়োজনে চালককে সতর্ক করবে। চালক অসতর্ক হয়ে পড়লে তার আচরণ বিশ্লেষণ করে ভুল ধরিয়ে দেবে এআই বট। ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার এই গিয়ার গাড়িতে লাগিয়ে নিলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে দলটি।
বিচারকদের কাছে প্রশংসা পেয়েছিল বাংলাদেশি কিশোরদের এই প্রকল্প। কিশোরদের মনে তখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব এগিয়ে আসতেই জটিলতার সূত্রপাত। চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করতে হলে পাঁচজনের দলকে যেতে হবে যুক্তরাষ্ট্রে। ২৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে সেই চূড়ান্ত পর্ব। আসা-যাওয়া মিলিয়ে খরচ ১২ লাখ টাকা, যা জোগাড় করা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
হাতে সময় ছিল মাসখানেক। আর্থিক সমস্যার ও ভিসা ইস্যুতে পাঁচজনের দল নেমে আসে দুজনে। তারপরও অর্থ সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ে। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তাদের যাত্রা। এমন সময়ই টিম স্মার্টের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তারা পাশে দাঁড়ায়, নাসার পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয় দুই কিশোর।
চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণকারী দলের কো অর্ডিনেটর মাহ্দী বিন ফেরদৌসের বাবা ফেরদৌস নওয়াজ বলেন, যেকোনো প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের আগে যথাযথ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ওই সময়ে আমাদের বাচ্চাদের যাওয়াটাই অনিশ্চিত। সেটা নিয়েই তাদের দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। একটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর কিছু অর্থের ব্যবস্থা হয়। সঙ্গে আমাদের সঞ্চয় আর ঋণ মিলিয়ে মোটামুটি ওদের যাওয়াটা পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু দুবাইয়ে বন্যা হলে ২০ এপ্রিলের ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়।
ফেরদৌস নওয়াজ আরও বলেন, বাতিল হওয়া টিকিটের টাকা ফেরত পাওয়া সময়ের ব্যাপার। ওদের যেতে হলে নতুন টিকিট করতে হবে। এখানেই শেষ পর্যন্ত দুই লাখ টাকার জন্য আমরা আটকে যায়। উপায় না পেয়ে আমরা একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক আহমেদ মুশফিকা নাজনীন আপাকে বিষয়টি জানাই। তার মাধ্যমেই পৌঁছে যাই বেসিসের মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল এবং তার দল টিম স্মার্টের কাছে। তাদের আন্তরিক সহযোগিতায় আমাদের বাচ্চারা বিশ্ব মঞ্চে গিয়ে ওড়াতে পেরেছে দেশের লাল-সবুজের পতাকা। ২৪ এপ্রিল চূড়ান্ত পর্বের দিন সকালে ওরা পৌঁছায়। এত তাড়াহুড়ার মধ্যেও ওরা সেরা পাঁচের মধ্যে থাকতে পেরেছে, এটি আমাদের বড় পাওয়া।
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অনুভূতি জানিয়ে মাহ্দী বিন ফেরদৌস বলছে, ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ফলাফলে আমরা সুযোগ পাই গ্লোবাল ফাইনালিস্ট হিসাবে। প্রতিযোগিতার যুদ্ধের চেয়ে তার আগের যুদ্ধ শেষে আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাই, সেদিন আমাদের ফাইনাল। আমরা যখন উপস্থাপনা শুরু করি, অনেক নার্ভাস ছিলাম। নতুন একটা দেশে পৌঁছেই প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া, এত মানুষের সামনে উপস্থাপনা— আমরা অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ইংরেজিতেও খুব দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি। আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী উপস্থাপনা করতেই পারিনি।
মাহ্দী আরও বলল, আসলে যেদিন জেনেছি আমরা চূড়ান্ত পর্বে সুযোগ পেয়েছি, সেদিন থেকে আমাদের যুদ্ধটা করতে হয়েছে অর্থ সংগ্রহের জন্য। কোনো প্রস্তুতিই নিতে পারিনি। সেই যুদ্ধ করতে না হলে কিংবা অন্তত আগে থেকে পৌঁছাতে পারলে হয়তো কারও কাছ থেকে গাইডলাইন নিয়ে রিহার্সেল করে আরও ভালো করতে পারতাম। আমরা চাই, আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক এসব প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতার জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকুক। সেইসঙ্গে থাকুক আমাদের দক্ষতা ও উপস্থাপনা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। আর টিম স্মার্টকে ধন্যবাদ, শেষ বেলায় তাদের সহযোগিতা না পেলে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর সুযোগই হতো না।
একুশে টিভির সাংবাদিক আহমেদ মুশফিকা নাজনীন বলেন, শেষ দিকে মাত্র ১২ লাখ টাকার জন্যে ওদের অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমি অনেক জায়গায় ওদের জন্য সাহায্য চেয়েছি। শেষ বেলায় যখন দুই লাখ টাকার জন্য আটকে গেলাম, তখন ওদের যাওয়ার শেষ সময়। মনে হচ্ছিল ওদের সঙ্গে আমিও হেরে যাচ্ছি। তখন আমার এক সাংবাদিক বন্ধুকে জানাই। ও বেসিসের ফেসবুকে গ্রুপে একটা পোস্ট দেয়। তখন কনটেন্ট ম্যাটার্সের সিইও এ এস এম রফিক উল্লাহ (সানা) ভাইয়ের যোগাযোগ হয়। জরুরিভিত্তিতে তিনি টাকার ব্যবস্থা করে দেন। এই কিশোরদের পাশে এগিয়ে আসার জন্য টিম স্মার্টকে ধন্যবাদ এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
মুশফিকা নাজনীনও মনে করেন, টাকা সংগ্রহে এত সময় না দিতে না হলে বাংলাদেশি কিশোররা নিজেদের প্রকল্প নিয়ে আরও প্রস্তুতি নিতে পারত। তাতে প্রতিযোগিতায় হয়তো তারা আরও ভালো করতে পারত।
মুশফিকা বলেন, পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সময় না পাওয়ায় ও কিছু দক্ষতা অর্জন করতে না পারায় এই কিশোররা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। এই দায়ভার আমাদের সবার। কারণ এ রকম মেধাবীদের জন্য আমরা সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই কোনো তহবিল করতে পারিনি। তাদের ভাষা বা উপস্থাপনার দক্ষতা বাড়াতে কোনো কোর্সের ব্যবস্থাও নেই। কিংবা থাকলেও হয়তো সেটি কেউ জানেই না। এই সমর্থনগুলো থাকলে নিশ্চয় আমাদের মেধাবী কিশোররা দেশকে গর্ব করার মতো আরও অনেক অর্জন উপহার দিতে পারত।
২০০৮ সাল থেকে আয়োজিত হচ্ছে নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জ। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা, নাসার হিউস্টন স্পেস সেন্টার ও ডেল টেকনোলজিসসহ মহাকাশ ও প্রযুক্তি জগতের বড় কিছু প্রতিষ্ঠান এ প্রতিযোগিতায় পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
এক্সা ম্যাক্স টিম স্মার্ট নট আ বোরিং টিম নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জ বেসিস বেসিস নির্বাচন