তাপপ্রবাহে রাজশাহী অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহতের শঙ্কা
৮ মে ২০২৪ ২২:১৩
রাজশাহী: দীর্ঘ এক মাস ধরে চলছে তাপপ্রবাহ। কখনও মাঝারি, কখনও তীব্র, আবার কখনও অতি তীব্র তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে। তবে দু’দিন থেকে তাপপ্রবাহ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এর আগের কয়েকদিনের তাপপ্রবাহের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহতের শঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বোরো ধানের পরাগায়ণ বিঘ্নিত হওয়ায় ধান চিটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে তা পরিমাণে খুব অল্প। এ ছাড়া, রবি ফসল ও সবজির উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন নিয়েও কৃষকরা ইতোমধ্যে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলায় এবার বোরো ধান, মসুর, খেসারি, মুগডাল, মরিচ, চিনাবাদাম, তিল, ভুট্টা, কালোজিরা বিভিন্ন ফসল মাঠে রয়েছে। প্রখর রোদ আর অসহনীয় তাপপ্রবাহের কারণে এসব ফসলের বেশিরভাগের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
রাজশাহী অঞ্চলের এই চার জেলায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হচ্ছে। এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৩০ মেট্রিক টন। কিন্তু জমিতে পানি রাখতে না পারা, তাপপ্রবাহের ধানের থোড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ আরও কিছু কারণে উৎপাদন কমার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। লু হাওয়া বা হিট শকে আক্রান্ত হচ্ছে মাঠের ধান। দীর্ঘদিনের বৃষ্টিহীন উচ্চ তাপপ্রবাহ থেকে এই হিট শকের সৃষ্টি। যদিও কিছু অঞ্চলে ইতোমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বোরো ধানে হিটশক (তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি) প্রবাহ হলে ধান চিটা হতে পারে। তাই এই মুহূর্তে জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখতেই হবে। না হলে উৎপাদন কমে যাবে। আম, কাঁঠাল এবং লিচু গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭-১০ দিন অন্তর) সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বাড়বে। এ ছাড়া, মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া, বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, পটল, শসা ও ঢ্যাঁড়শ প্রভৃতির জমিতে তিন-চারদিন পর পর সেচ দিতে হবে। অন্যদিকে, পাতাজাতীয় সবজি যেমন- ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি, লাউশাক প্রভৃতি ক্ষেতে দুই-তিন দিন অন্তর সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
তবে বোরো ধান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কৃষকরা বলছেন, অনেকে এলাকায় এখনও ধান কাটা শুরু হয়নি। যখন শুরু হবে তখন শ্রমিক সংকটও দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে অনেক জমির ধান চিটা হতে শুরু করেছে।
তানোর উপজেলার গৌরাঙ্গপুর গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান এবার চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। কিন্তু চলমান তাপপ্রবাহে জমিতে দেখা দিচ্ছে পানি শূন্যতা। এতে জমির ধান চিটা হয়ে যায় কি না- সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন কাটছে এই বোরো চাষির।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আগে ১ ঘণ্টা পানি দিলে একবিঘা জমি সেচ হয়ে যেত। এখন দেড় ঘণ্টায়ও সেই পানি হয় না। পানি দিতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাতেও এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে।’
এ সময় জমিতে পানি ধরে রাখার পরামর্শ কৃষি কর্মকর্তাদের। কিন্তু চাষিরা জানান, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে টেকসই সেচ ব্যবস্থা। ধানের ফুল আসার জন্য সর্বোচ্চ সহনীয় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও আবহাওয়া অফিস বলছে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ওঠানামা করছে ৪০ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ অবস্থায় ঝড়-বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা চাষিদের।
নাচোল উপজেলার বেড়াচৌকি গ্রামের কৃষক আবদুল আহাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি হলে সমস্যা হতে পারে। এখন প্রতিদিন ধানে পানি দিতে হচ্ছে। তা নাহলে ধানের ক্ষতি হতে পারে।’
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মাহমুদুল ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রখর রোদে বোরো ধানের পরাগায়ণ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে ধানে চিটা হতে পারে। তাছাড়া রবি ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি আর অধিক তাপমাত্রার কারণে ফসলের খেতে নানা রোগবালাই দেখা দিতে পারে। তবে দ্রুত বৃষ্টিপাত হলে কৃষকরা কিছুটা হলেও ক্ষতি পোষাতে পারবে।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফজলুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে শস্যের ফলনে কিছুটা কমতি দেখা দিতে পারে। সেটি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এবার বোরো ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হবে। এ ছাড়া, এবার বোরো ধানের জমিতে কোনো ধরনের পোকামাকড় বা রোগবালাইয়ের আক্রমণ নেই। এতে ধানের ফলন ভালো হবে।’
সারাবাংলা/পিটিএম