পাহাড়ে ৩ সংগঠনের রেষারেষি, ৬ মাসে ২৪ খুন
২৯ মে ২০১৮ ১২:৫২ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ১৯:৪৫
।। জসিম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।
খাগড়াছড়ি: পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চল ঘোষণা দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। যেটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বা শান্তিচুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই দশক অতিবাহিত হলেও সমাধান হয়নি পাহাড়ের সমস্যা। বরং দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি।
পাহাড়ি তিন সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্ব রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে। গত ৬ মাসে ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জনসংহতি সমিতি এমএন লারমার ২৪ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন পার্বত্য জেলায়।
চুক্তি পরবর্তী সময়ে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা পিসিজেএসএস নামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। অপরদিকে চুক্তির বিভিন্ন ধারার বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ।
মতার্দশের অমিলে ২০০৭ সালে ভাঙন ধরে পিসিজেএসএস এ। ওই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রথম নির্বাচিত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শপন্থী আত্মসমর্পণকারী পিসিজেএসএস নেতারা বিভক্ত হয়ে পিসিজেএসএস-এমএন লারমা নামে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ভাঙন ধরে ইউপিডিএফ’র মাঝে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, বিগত ৬ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৪ জন খুন হয়েছেন। ২০১৬ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত বন্ধ থাকলেও গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তা আবার শুরু হয়। এতে উদ্বেগ বাড়ে পাহাড়ে। গত ৩ ও ৪ মে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও এমএন লারমার কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি শক্তিমান চাকমা এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ছয়জন খুন হয়েছেন।
গত ২৮ মে রাঙ্গামাটির করল্লা ছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফের তিন কর্মী মারা গেছেন। প্রতিপক্ষের গুলিতে এরা মারা যান।
ইউপিডিএফের তিন কর্মী হলেন সঞ্জীব চাকমা, স্মৃতিবিকাশ চাকমা, অটল চাকমা।
গত ২১ মে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় উজ্জল কান্তি চাকমা নামে ইউপিডিএফ’র এক সাবেক সদস্য খুন হন। পরের দিন ২২ মে খাগড়াছড়ি শহরের স্বণির্ভর এলাকায় দিনদুপুরে দুই পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পেছনের মূল কারণ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আধিপত্য বিস্তার। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসন ছিনিয়ে নিতে অনেক আগে থেকে মরিয়া ইউপিডিএফ। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক শত্রু পিসিজেএসএস’র সঙ্গে সখ্যতা বৃদ্ধি করে ইউপিডিএফ। কিন্তু বিগত ছয়মাসে ইউপিডিএফর আধিপত্যের ধস মোকাবিলা করতে গিয়ে পাহাড় অশান্ত হয়ে উঠছে।
এমএন লারমার রাজনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক বিভূরঞ্জন চাকমা বলেন, ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপ পাহাড়ে শান্তি চায় না। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পাহাড়ে শান্তি ফেরার কথা। কিন্তু তাদের বিরোধিতার কারণে শান্তির পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বলয় থেকে যে বের হয়ে প্রতিবাদ কিংবা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তাদের তারা হত্যা কিংবা গুম করছে। যার প্রমাণ মিলে তপন জ্যোতি চাকমাসহ অন্যান্যদের খুন হওয়ার ঘটনায়। পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাহাড়ি জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধে জেএসএসর সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি আংশিক সত্য জানিয়ে ইউপিডিএফ সমর্থিত গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বিরোধিতা করেনি। চুক্তির কিছু ধারার বিরোধিতা করে আসছে। বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন করে চুক্তির বাস্তবায়ন করতে হবে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইউপিডিএফ’র জনপ্রিয়তা বাড়ছে দাবি করে তিনি বলেন, নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হলেও সংসদে যেতে দেওয়া হয়নি। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইউপিডিএফ যে কোনো সমঝোতা করতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অংগ্য মারমা বলেন, তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা একসময় ইউপিডিএফ’র সঙ্গে থাকলেও সাংগঠনিক বিরোধী কর্মকাণ্ডের অপরাধে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমএন লারমা সমর্থিতদের ছত্রছায়ায় তিনি ও ইউপিডিএফ থেকে বিভিন্ন সময় বহিষ্কৃতরা মিলে নতুন সংগঠন তৈরি করেন। কিন্তু পাহাড়ি জনগণ সেটিকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নয় বরং নব্য মুখোশ বাহিনী হিসেবে জানে। হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী না করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান তিনি।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান বলেন, সম্প্রতি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশসহ যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/একে