Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জলবায়ু বিপর্যয়ে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১০ মে ২০২৪ ১১:৫৫

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে আন্দোলন করে যাচ্ছেন পরিবেশ অধিকার কর্মীরা। ছবি: অনলাইন

বৈশ্বিক উষ্ণতা আর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে পরিবেশবাদীরা সোচ্চার দীর্ঘ দিন ধরেই। নানা মাধ্যমে বিশ্বনেতাদেরও প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ তথা পৃথিবীকে রক্ষার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন তারা। কপ সম্মেলনসহ বিভিন্ন ফোরামে বিশ্বনেতারাও জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব মোকাবিলায় নানা অঙ্গীকার করে থাকেন। এর মধ্যে বহুল আলোচিত প্রতিশ্রুতিটি হলো— বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।

বিজ্ঞাপন

কপ সম্মেলন থেকে শুরু করে জলবায়ুবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের এই অঙ্গীকার করে থাকেন সবাই। কিন্তু কদিন আগেই প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ান বিশ্বের বিখ্যাত সব জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জরিপ চালিয়েছে। তাতে উঠে এসেছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সেই ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সমর্থ হবে না বিশ্ব। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ বলছে, জলবায়ু বিপর্যয়ে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে গোটা বিশ্ব।

বিজ্ঞাপন

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির সীমারেখা স্পর্শের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব। বৈশ্বিক জলবায়ু সম্পর্কিত বিষয়ে যদি অভাবিত কোনো পরিবর্তনমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এটি ঠেকানো সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীরা বারবার পরিবেশ নিয়ে যে সতর্কর্তার কথা বলে আসছিলেন, সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। সেগুলোকে এখনই সতর্কবার্তা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে কোটি কোটি জীবন্ত সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে রাতারাতি বাস্তবায়নের উপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।

গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে অন্তত ৪০০ জ্যেষ্ঠ গবেষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসরকার প্যানেলে কাজ করে থাকেন। তাদের প্রায় ৮০ শতাংশেরই ধারণা, প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় তাপমাত্রা বাড়বে কমপক্ষে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার তীব্র সমালোচনাও করেছেন তাদের কেউ কেউ।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়ামের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত করার উদ্যোগ একদম সুতার ওপর ঝুলছে। ত্রিশের এই দশকে এসে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে সীমিত রাখার প্রচেষ্টাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে আমরা হারব নাকি জিতব— সেদিকে রাজনৈতিক ও শিল্প নেতারা তাকিয়ে আছেন। তাদের বুঝতে হবে, আমরা একদম খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীরা খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন— এর চেয়ে আর বড় ক্রান্তিকাল মানবজাতির জন্য আসেনি।’

২০২১ সালে অনুষ্ঠিত কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট অলক শর্মা বলেন, ‘গার্ডিয়ানের যে জরিপ, বিশ্বের সব দেশের সরকারের জন্য একটি জরুরি সতর্কবার্তা। এই জরিপ বলছে, জলবায়ু প্রশ্নে সরকারগুলোর গাঁ বাঁচিয়ে চলার সময় আর নেই। বরং তারা জলবায়ু নিয়ে এরই মধ্যে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলোকে জরুরিভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে আরও জোর দেওয়ার সময় এখনই।’ কপ২৮-এ বিশ্বনেতারা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে যাওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য এখনই কাজ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অধীনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি রাখার বিষয়ে সম্মত হয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। ওই চুক্তি দেখভাল করছেন জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক প্রধান ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেস। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু বিজ্ঞানীরা তাদের কাজ করছেন। তারা আমদের বারবার বলে যাচ্ছেন আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। এখন এটি আমাদের সিদ্ধান্ত, আপাত অসম্ভব নতুন বাস্তবতার মুখে আমাদের কী করণীয় রয়েছে।’

জলবায়ু বিপর্যয়ের শঙ্কা সত্ত্বেও ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেস ওই অর্থে নৈরাশ্যবাদী নন। তিনি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের ক্ষেত্রে এক ধরনের সামাজিক রূপান্তরের অবস্থাতে বিশ্ব পৌঁছেছে। তার অর্থ এই নয় যে আমরা এক ধরনের কাল্পনিক ভবিষ্যত দেখব। আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যপক প্রভাব সবখানে পড়েছে। আবার ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোও আসছে। ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে যাওয়া যে বিশ্ব, এটি অবশ্যম্ভাবী নয়।

১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়ামের এই সীমা প্রথম আলোচনায় আসে অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটসের (অ্যাওসিস) প্রস্তাবনায়। সংস্থাটির চেয়ার ফাতুমানাভা পা’ওলেলেই লুটেরু বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আমাদের দ্বীপগুলো আক্ষরিক অর্থেই ডুবে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘাটতি আমদের এক বিপর্যয়কর ক্ষতির বাস্তবতার দিকে ঠেকে দিচ্ছে। গার্ডিয়ানের জরিপটি এই সময়ের বিশ্বের জন্য নিশ্চিতভাবেই একটি সতর্কঘণ্টা।

আফ্রিকাভিত্তিক জ্বালানি খাতের থিংক ট্যাংক পাওয়ার শিফট আফ্রিকার মোহামেদ আদৌ বলেন, সরকারগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা নিয়ে নিষ্ক্রিয়। এটি ভালো একটি দিক যে তাদের এই নিষ্ক্রিয়তার ফলাফলের ভয়াবহতা জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বারবার তুলে ধরছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে আমাদের দেশে। আমরাও সেটি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে অনুভব করি। আমার দেশ কেনিয়া। সেখঅনে ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর খরা দেখা দিয়েছে। আবার গত সপ্তাহেই কিন্তু ভয়াবহ বন্যায় শত মানুষ প্রাণ হরিয়েছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এ পরিস্থিতিকে যতটা আতঙ্কজনক হিসেবে দেখছেন, বিশ্বনেতারাও যদি তেমনটা দেখতেন!

তরুণ পরিবেশ কর্মীদের কণ্ঠেও বিজ্ঞানীদের সেসব আশঙ্কার কথাই প্রতিফলিত হচ্ছে। উগান্ডার রাইজআপ আন্দোলনের ভ্যানেসা নাকাতে বলেন, ‘তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা একটি রক্ষাকবচের মতো। এই রক্ষাকবচকে লঙ্ঘন করা বিশ্বের কোটি মানুষকে মৃত্যুদণ্ড সাজা দেওয়ার সামিল। এখনই যদি আমরা কার্যকর কিছু করতে না পারি, কেউই নিরাপদে থাকবে না।’

ভারতের সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহের ভয়াবহতা তুলে ধরে ফ্রাইডেস ফর ফিউচার ইন্ডিয়ার দিশা রাভি বলেন, ‘নেতাদের আত্মপ্রসাদ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাপমাত্রা ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী নয়। তবে সেটি ঠেকাতে হলে সত্যিকার অর্থেই বড় দেশগুলোর থেকে কার্যকর প্রতিশ্রুতি আর পদক্ষেপ প্রয়োজন।’

নীতিমালা বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারাও গার্ডিয়ানের জরিপের ফলাফলে হতাশা জানিয়েছেন। তারাও দ্রুত পরিবর্তনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জলবায়ু নীতিমালা বিশেষজ্ঞ র‌্যাচেল কাইট বলেন, বিজ্ঞানকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটি আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা জানে না। এর চেয়ে দুঃখজনক ও হতাশাজনক আর কিছুই হতে পারে না। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এমন উদ্ভাবন দরকার, যেখানে আমাদের বিজ্ঞানীরা সেই কাজগুলো করার সুযোগ পাবেন যা তাদের করা প্রয়োজন।

জলবায়ু অর্থনীতিবিদ নিকোলাস স্টার্ন বলেন, চূড়ান্ত বিপর্যয় ঠেকাতে বিশ্বনেতাদের পদক্ষেপ নেওয়ার যে ঘাটতি এবং তাদের ওপর সবার যে আস্থার অভাব, গার্ডিয়ানের জরিপে সেটিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখনো রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে কাজ করার সময় শেষ হয়নি। তবে এখন যেটিই করতে হবে, তার পরিমাণ বিশাল, করতেও হবে অনেক দ্রুত।

গার্ডিয়ানের ওই জরিপে যারা অংশ নিয়েছেন, তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যর্থতার পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে বড় কারণ মনে করছেন। ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভের হারজিত সিং বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে বিশেষ করে ধনী রাষ্ট্রগুলো সারা বিশ্বের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা না করে জীবাশ্ম জ্বালানিতে পরিচালিত শিল্পায়নকেই ধারাবাহিকভাবে প্রাধান্য দিয়ে গেছে। এখন সবচেয়ে ভয়ানক যে ফলাফল, সেটি ঠেকানোর সামান্য সুযোগ আমাদের সামনে অবশিষ্ট আছে। কিন্তু সেখানেও জরুরিভিত্তিতে রূপান্তমূলক নীতিমালা প্রয়োজন, যেখানে মুনাফার বদলে প্রাণ ও প্রকৃতিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।’

রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেও দ্রুত ও জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে কথা বলছেন। যুক্তরাজ্যের গ্রিন পার্টির সংসদ সদস্য ক্যারোলাইন লুকাস বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের যে জরুরি অবস্থার মুখোমুখি আমরা, তার বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীরা এখন শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। এখন রাজনীতিবিদদের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুক্তরাজ্যের ছায়া জলবায়ুমন্ত্রী এড মিলিব্যান্ড বলেন, প্রতিটি ডিগ্রির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাংশ আমাদের এই গ্রহ এবং পরবর্তী প্রজন্মের অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই বিশ্বের সব দেশে যেসব সরকার রয়েছে, তাদের কাছ থেকে কথার ফুলঝুড়ির পরিবর্তে এখন সর্বোচ্চ পরিমাণে জলবায়ুবিষয়ক পদক্ষেপ প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভ্যানিয়ার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য ক্রিসি হুলাহান বলেন, ‘(গার্ডিয়ানের জরিপ) আমাদের আরও দ্রুত ও নির্দলীয়ভাবে কাজ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে।’ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ব্যাস এইখআউট বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের হতাশাজনক কথার পেছনের কারণটি আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

সারাবাংলা/টিআর

জলবায়ু পরিবর্তন জলবায়ু বিপর্যয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি বৈশ্বিক উষ্ণতা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর